আমাদের পূর্বপুরুষেরা হয়ত খুব একটা সাজানো গোছানো ছিলো না, একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিলো। হয়ত তাই তাদের হাড়ের ফসিল খুঁজে বের করাও এতখানি কষ্টকর! মাঝে মাঝে একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হাড়ের ভাঙ্গা অংশ জোড়া দিয়ে ফসিলগুলোর প্রকৃতি বুঝতে হয়।
১৯৮৪ সালে কেনিয়ায় তুরকানা লেকের কাছে আবিষ্কৃত হয় আমাদের পূর্বপুরুষের কঙ্কাল। ৩০ বছর পরেও “তুরকানা বয়” নামে খ্যাত সেই ফসিল নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ এতটুকু কমেনি। কারণ এত বছরের মধ্যে আবিষ্কৃত সবচেয়ে সম্পূর্ণ কঙ্কালগুলোর মধ্যে এটি একটি। বলা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের সবচেয়ে কাছাকাছি যাওয়ার উপায় এই ফসিল। লেখার সুবিধার জন্যে ধরা যাক তার নামই “তুরকানা”।
তুরকানা যখন মারা যায়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। এরপর প্রায় ১৫ লক্ষ বছর ধরে তার হাড় লেকের তলানিতে সংরক্ষিত ছিল। এখন পর্যন্ত পাওয়া আমাদের একেবারে পূর্বপুরুষদের কঙ্কালগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে সম্পূর্ণ।
এই তুরকানা লেকটি মানব বিবর্তনের অন্যতম সাক্ষী। এর আগে এখান থেকে উদ্ধার হয় অন্যান্য মানব ফসিল, যা একসাথে প্রায় ৪০ লক্ষ বছর ধরে মানব বিবর্তন সম্পর্কে অনেক কিছু জানান দেয়। ধারণা দেয়, আমরা কীভাবে এসেছি, আমাদের পুর্বপুরুষরাই বা কেমন ছিলো। সেই সাথে জানায় তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি।
এখন একটু তুরকানা লেকের কথায় আসা যাক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই লেকের আশেপাশে এখন শুধুই মরুভূমি পাওয়া যাবে।
হ্যাঁ, তুরকানা লেক আরও অনেক বড় ছিলো। তবে তা আজ থেকে প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগের কথা। এরপর ২০ লক্ষ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই লেক শুকিয়ে কিছু কিছু জায়গায় একেবারে “নেই” হয়ে গেছে।
যে নদী জলের ভারে হারাতো প্লাবনে
তুরকানা লেক যখন আর্দ্র ছিলো, তখন মানব সভ্যতা বিস্তারের জন্যে ছিলো আদর্শ জায়গা। আর মরে যাবার পর তা দাঁড়ালো ফসিল সংরক্ষণের জন্যে আদর্শ জায়গা হিসেবে! এর কারণটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। এই লেকের অবস্থান আগ্নেয়গিরির কাছে। তার মানেই হচ্ছে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের সামান্য নড়াচড়াই নতুন স্তরের সৃষ্টি করবে। আর এই স্তরগুলোর মাঝেই এতদিন ধরে ফসিলগুলো সংরক্ষিত ছিলো।বছরের পর বছর ধরে বৃষ্টিতে ক্ষয়প্রাপ্ত স্তর থেকেই বের হয়ে আসে এই ফসিলের অংশ বিশেষ।
আমরাই একমাত্র “মানুষ” নই!
বিবর্তন সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, “মানুষ” মানেই “আমরা”। তথ্য প্রমাণ কিন্তু বলে ভিন্ন কথা। ১৯৭২ সালে খুঁজে পাওয়া খুলি এবং হাত পায়ের কিছু হাড় (“skull 1470”) বলে সেটি আমাদেরই ১৯ লক্ষ বছরের পুরাতন আত্মীয় হোমো রুডলফেন্সিস-এর!
এই আবিষ্কার বারবার একটি কথাই নির্দেশ করে আমাদের ভুল অহংবোধের প্রতি। নির্দেশ করে যে, আমরাই একমাত্র মানুষ নই। আমাদের পূর্বপুরুষদের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি ছিলো, যার মধ্যে ১৯৭২ সাল নাগাদ H. habilis, H. erectus, এবং Paranthropus boisei-এর কথা আগেই জানা গিয়েছিলো। রুডলফেন্সিস ছিলো সেই তালিকায় নতুন যুক্ত নাম।
আরও চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, আজ থেকে ১৭-১৯ লক্ষ বছরের মাঝে কোনো এক সময়ে উল্লিখিত তিন প্রজাতির মানুষ একই সাথে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে! কিন্তু এই মুহুর্তে টিকে আছি শুধু আমরাই।
তবে এর মধ্যে হোমো ইরেক্টাস-এর গুরুত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি। কারণ হোমিনাইনদের মধ্যে এই প্রজাতিকে সরাসরি আমাদের পুর্বপুরুষ হিসেবে ধারণা করা হয়। এরাই প্রথম হোমিনাইন যারা আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ এবং এশিয়া চষে বেড়িয়েছে! তাদের হাঁটার ধরনও ছিলো আমাদের মত। ঠিক যেমন আমরা আমাদের শরীরের ওজন পেলভিসের উপর দিয়ে হাঁটি অপেক্ষাকৃত বড় ধাপ ফেলে। আর ছিলো আমাদের মতই বড় আকারের মস্তিষ্ক যা অন্য হোমিনাইনদের ছিলো না।
ছুটেছি তবু পিছু…
হাঁটতে গেলে আমরা দু’পা ব্যবহার করি, তাই তো? তার মানে নিশ্চয়ই আমাদের হাত খালি থাকে? সেই “তুরকানা” ছেলেটিও, মানে তার প্রজাতিও আমাদের মতই দু’পায়ে হাঁটতে পারতো। আর যদি হাত খালিই থাকে, তার মানে অন্য প্রাইমেটদের মত তারা দ্রুত ছুটতেও পারতো! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দ্রুত দৌড়ানো কীসের পেছনে? এবং কী নিয়ে?
এর একটি সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে বর্শা। হোমো ইরেকটাস-এর হাতের এনাটমি বলে, তারা যেকোনো কিছু নিক্ষেপ করতে এবং বহন করতে সক্ষম ছিলো।অবশ্যই বর্শার কোনো ফসিল পাওয়া সম্ভব না, কিন্তু ২০১৩ সালে হোমো ইরেকটাস-এর উপর করা স্টাডি সেই সম্ভাব্যতাকেই নির্দেশ করে।
অন্যদিকে আমাদের “এপ” পূর্বপুরুষদের নিক্ষেপ করার ক্ষমতা খুবই কম ছিলো। এর কারণ হয়তো আমাদের “এপ-সদৃশ” পুর্বপুরুষরাও গাছে বসেই বেশি সময় ব্যয় করত বলে! যার মানে দাঁড়ায়, হোমো ইরেকটাসরা শিকারে আরও বেশি সক্ষম ছিলো।
এর কারণ হচ্ছে, সেই সময়ে বনভূমিগুলো ধীরে ধীরে উন্মুক্ত ঘাসের মাঠে পরিণত হচ্ছিলো। অর্থাৎ বড় শিকারি প্রাণি থেকে লুকানোর জন্যে জায়গার অভাব। তাই হোমো ইরেকটাস পর্বের কাছে দুটি পথই খোলা ছিলো। হয় গাছে আশ্রয় নেয়া অথবা সরাসরি শিকারী প্রাণির সাথে লড়াই। আর দৃশ্যত তারা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেয়।
আগেই বলা হয়েছে, হোমো ইরেকটাস শ্রেণি অস্তিত্বের লড়াইয়ে শিকারি প্রাণিদের সাথে লড়াইয়ের পথই বেছে নিয়েছিলো। তাই দলবদ্ধভাবে থাকাই ছিলো নিরাপদ থাকার অন্যতম উপায়। যেসব দল একসাথে শিকার এবং বসবাস করতো, তাদের শিকারে পরিণত হবার সম্ভাবনাও অবশ্যই অন্যদের চেয়ে কম ছিলো। আর এই তাগিদই হোমো ইরেকটাসদের আরও বেশি সামাজিক হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। অন্তত আমাদের হাতের তথ্য প্রমাণ তাই বলে।
আদি প্রস্তর যুগের হাত দিয়ে নিক্ষেপ করা যায় এমন অস্ত্র এই সময়েরই তৈরি। এই সময়ের তৈরি কুঠার একই সাথে আফ্রিকা এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও পাওয়া যায়। তাই আদি মানবরা যে এই অস্ত্র নিজেরা তৈরি করতো এবং তৈরি করার পদ্ধতি অন্যদেরও জানাতে পারতো, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
২০১১ সালে লেক তুরকানার পাশেই পাওয়া যায় প্রায় ১৭ লক্ষ বছরের পুরনো হাতে নিক্ষেপ করা কুঠার। ধারণা করা হয়, এটি হোমো ইরেকটাসদেরই তৈরি (তথ্য সূত্রঃ ন্যাচার সাময়িকী)। আর এই আদি প্রস্তর যুগের প্রযুক্তি প্রায় ১০ লক্ষ বছর ধরে টিকেছিলো। বলা যায় এই কুঠার সে যুগে ছিলো সুইস আর্মি ছুরির সমমূল্যের!
তো মূলত এই প্রস্তর যুগের কুঠারের কাজ কী ছিলো?
ধারণা করা হয়, এটি দিয়ে মাংস কাটা, হাড় থেকে মাংস আলাদা করা এবং বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ ছিন্ন করা হতো। আর যেহেতু এই অস্ত্র ১০ লক্ষ বছর ধরে টিকেছিলো, তাই কীভাবে এই কাজ করা হয়, সেটা অন্যদের শেখানোও হয়তো সহজ ছিলো।
তাই বলে এ ধারণা আসা ঠিক নয় যে, হোমো ইরেকটাসদের নিজস্ব কোনো ভাষা ছিলো। একটি গবেষণার অংশ হিসেবে স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জন সিয়া তাঁর ৫০০ শিক্ষার্থীদের একই ধরনের পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে দিয়েছিলেন। এবং কোনোরকম ভাষার ব্যবহার ছাড়াই তারা একে অন্যকে অস্ত্র তৈরির কৌশল শেখাতে সমর্থ হয়েছিলো।
আমাদের আগে কারা ছিলো?
লেক তুরকানা আরও একটি কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মানব বিবর্তনের আগে কী ছিলো? “হোমো” গণ বিবর্তিত হওয়ার আগে কী ছিলো সেখানে? এখানেই চলে আসছে সেই বিখ্যাত “লুসি”র কথা। ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়াতে আবিষ্কৃত হয় প্রায় ৩২ লক্ষ বছরের পুরনো ফসিল Australopithecus afarensis, যার ডাকনাম লুসি। লুসির প্রজাতিকে আমাদের সম্ভাব্য সরাসরি পুর্বপুরুষদের মধ্যে একটি শক্ত প্রতিযোগী হিসেবে ধরা হয়েছিলো। কিন্তু যে সময়ে লুসিকে আবিষ্কার করা হয়, সে সময় লুসির আগের সময়কার ফসিল নিয়ে খুব বেশি জানা যায়নি। অধিকাংশ ফসিলই ছিল লুসির পরবর্তী সময়ের। যার কারণে লুসির ঠিক আগের আমাদের সরাসরি পুর্বপুরুষরা কী করে এলো, সে নিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছিলো না। যার মানেই ছিলো আবার লেক তুরকানায় ফিরে যাওয়া এবং নতুন কিছুর সন্ধান করা।
ঠিক তখনই ১৯৯০ সালে পাওয়া যায় লুসির প্রজাতির পূর্বপুরুষের সন্ধান। A. anamensis ছিলো লেক তুরকানা থেকে পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন প্রজাতির ফসিল। ৪০ লক্ষ বছর পুরনো ফসিল।
তারই কয়েক বছর পর পাওয়া যায় Kenyanthropus platyops, যার নাম দেয়া হয় “Flat-faced man” । এটি ছিলো ভিন্ন আরেকটি প্রজাতি। এই প্রজাতি এবং লুসির প্রজাতি প্রায় একই সময়ে পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে আজ থেকে ৩৫ লক্ষ বছর আগে। যার মানে এই দাঁড়ায় যে, আমাদের “হোমো” গণের পুর্বপুরুষ হিসেবে সম্ভাব্য অনেকেই রয়েছে এবং আমাদের বিবর্তন যে শুধুমাত্র একটা কমন লাইন থেকে হয়েছে, সে ধারণা ক্রমেই আরো মলিন হচ্ছে।
এদিকে লেক তুরকানা থেকে মাত্র গত বছরই আবিষ্কার করা হয়েছে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন পাথরের তৈরি হাতিয়ার। বয়স হিসেব করলে এটি প্রায় ৩৩ লক্ষ বছর পুরনো। আমাদের আগের ধারণা ছিলো, শুধু মাত্র হোমো গণই পাথরের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারতো। কিন্তু আবিষ্কৃত হাতিয়ারগুলোর বয়স হোমো গণের ফসিলের চেয়েও পুরাতন। অর্থাৎ আমাদের পূর্বের বিভিন্ন প্রজাতি, যেমন A. afarensis অথবা K. platyops অবশ্যই পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে পারতো।
প্রমাণের অনুপস্থিতি মানেই অনুপস্থিতির প্রমাণ নয়
লেক তুরকানা হয়ত ফসিল সংরক্ষণের জন্যে আদর্শ ছিলো, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আফ্রিকার অন্যান্য জায়গায় মানব বিবর্তন হয়নি। যেমনঃ আমাদের অনেক পুর্বপুরুষই রেইন ফরেস্টগুলোতে বসবাস করে এসেছে। কিন্তু সেখানকার মাটি অম্লধর্মী হওয়ায় হয়ত ফসিলগুলো টিকে থাকেনি। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, লেক তুরকানা অনেক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। লক্ষাধিক বছর আগে বসবাস করা বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে তুলনাও সহজ হয়ে যাচ্ছে এর মাধ্যমেই।
ভাবতেই কেমন লাগে, তাই না? এই ভৌগলিক ফাঁদের কারণে আমরা আজ তাদের জীবন নিয়ে ধারণা পাচ্ছি যারা আমাদেরও লক্ষ বছর আগে এই পৃথিবীতেই বাস করে গেছে!