প্রকৃতি বরারবরই খুব দুষ্টু প্রজাতির। সে নিজের অন্দরমহল কাউকে দেখতে দিতে রাজি হয় না। এবং এগুলো কোনো চটিগল্পের লাইনও না, মহাবিশ্ব নিয়ে লিখার চেষ্টা করছি আর কী! যা হোক, তারপরেও প্রকৃতির এই গোপন ভাণ্ডারে পৃথিবীর সেরা সেরা সব মেধা যুগ যুগ ধরে বাংলা সিনেমার ভিলেন স্টাইলে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। এসব হামলা থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃতিও নানারকম ছলনায় ভুলিয়েছে এসব মেধাবীদের। যেমন ধরা যাক স্যার আইজ্যাক নিউটনের কথা। এই ভদ্রলোক প্রথম মানুষ প্রকৃতি যার প্রেমে পড়েছিলো। আর ব্রিটিশরা কখনোই সুবিধার প্রাণী ছিলো না, প্রেমের সুযোগে ভদ্রলোক প্রকৃতির অন্দরমহল দেখে ফেলেন অনেকখানি। ১৬৬৫ সালে ইউরোপে প্লেগের প্রকোপ দেখা দেয়। তখন স্যার আইজাক নিউটন কেমব্রিজের ছাত্র। কেমব্রিজ কর্তৃপক্ষ প্লেগের ভয়ে বাধ্য হয়ে ভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করে। এবং টানা দুইবছর ভার্সিটি বন্ধ থাকে। আর বিশ্বাস হোক বা না হোক, মাত্র এই দুই বছরের মধ্যে তিনি তাঁর জীবনের সব গবেষণাগুলো করে ফেলেন যেগুলো আমরা ক্লাস সিক্স থেকে পিএইচডি লেভেল পর্যন্ত ফিজিক্স আর ম্যাথে পড়ি! তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫! আগেই বলেছি ব্রিটিশরা সুবিধার জাতি না, তাই মাত্র দুই বছর পরেই তিনি প্রকৃতির উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, বাকি জীবন তিনি অপব্যায় করেছেন আলকেমি নামক এক ছদ্মবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে। এই মানুষটি আরও চেষ্টা চালিয়ে গেলে প্রকৃতি হয়তো তার অন্দরমহলের সবকিছুই দিয়ে দিত বাধ্য হয়ে, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তা হয়নি। প্রকৃতি সফলভাবে তার ইজ্জত বাঁচাতে সক্ষম হয় সে যাত্রায়।
তারপরও সময়ের সাথে সাথে আমরা তার অন্দরমহলের ছবি আস্তে আস্তে আঁকতে থাকি। কিন্তু কোথায় যেন সে অবোধগম্য থেকেই যায়। অবশেষে আসে বিংশ শতাব্দী। এবং একগাদা বিস্ময়কর প্রতিভাবান মানুষ সে সময় উঠেপড়ে লাগে প্রকৃতির ইজ্জত হরণে। তাঁদের দুই শিরোমণি – ম্যাক্স প্লাঙ্ক আর স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন হাজির হন কালজয়ী দুই থিওরি নিয়ে, একটা হল প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম থিওরি আর আরেকটা হল আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি। এই দুই থিওরির সামনে প্রকৃতি নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয় নিজের স্বরূপ উন্মোচিত করতে। কিন্তু প্রকৃতিও বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো, সেও তাই উদাস গলায় বিজ্ঞানীদের জানিয়ে দেয় “দেহ পাবি তো মন পাবি না”! বিজ্ঞানীরা হতাশাভরে আবিষ্কার করে এই দুই তত্ত্ব আলাদা আলাদাভাবে প্রকৃতিকে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেও তারা কিছুতেই একসাথে কাজ করতে নারাজ, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট লেভেল পর্যন্ত প্রকৃতি বোধগম্য, তারপরে খেই হারিয়ে যায়! মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে পরমাণুর সাইজ পর্যন্ত রিলেটিভিটির রাজত্ব, এই লেভেলের সবকিছু সে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে; কোয়ান্টাম মেকানিক্স এখানে জিম্বাবুইয়ান ডলার। আর পরমাণুর চেয়ে ছোট সাইজের ক্ষেত্রে আবার কোয়ান্টামের রাজত্ব, সেখানে রিলেটিভিটি অচল। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুটার মিলন হওয়া খুবই জরুরী, যেমন বিগ ব্যাং এর আদিবিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট। আর এখানেই প্রকৃতির চক্রান্তে দুই থিওরি একসাথে কাজ করতে নারাজ। ফলে আবার সেই অবোধগম্যতা! প্রকৃতির আরেক প্রেমিক স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন বোধহয় সেই হতাশাতেই বলেছিলেন – ‘মহাবিশ্বের সবচেয়ে অবোধগম্য ব্যাপার এই যে এটা বোধগম্য!’ শতবছর ধরে এটাই অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সবচেয়ে বড় ধাঁধাঁ, কিভাবে এদের একত্র করা যায়!
২০১৬ সালটা অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বা জ্যোতিপদার্থবিদ্যার ইতিহাসে একটা মাইলফলক। এই বছর মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে সনাক্ত করা গেছে, এই বছর পঞ্চম একটা মৌলিক বলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা ডার্ক ম্যাটারকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম এবং এই বছরেই এই দুই ঘাড়ত্যাড়া থিওরিকে এক করার মতো একটা থিওরি পাওয়া গিয়েছে!
ব্যাপারখানা বুঝতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে ওয়ার্মহোল বা কীটগহ্বর কী। ক্রিস্টোফার নোলান নামক এক জিনিয়াসের একটা মুভি আছে, নাম Interstellar, যারা দেখেননি তারা আসলেই ভাগ্যবান, আমি এখনও ভাবি যদি এই মুভিটা আবারও প্রথমবার দেখার মতো অনুভূতি পেতাম! যা হোক, এই মুভিতে ওয়ার্মহোলের কনসেপ্টটা খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে, ধরা যাক আপনি একটা কাগজের একমাথায় একটা ফুটো করলেন, আর আরেকমাথায় আরেকটি ফুটো করলেন। ফলে দেখা যাচ্ছে দুই ফুটোর মধ্যে একটা দূরত্ব আছে যা কাগজের দৈর্ঘের সমান। কিন্তু আপনি যদি কাগজটা ভাঁজ করে ফুটো দুটো একটা আরেকটার উপর নিয়ে যান তাহলে কী হবে? দূরত্ব শুন্য হয়ে যাবে। ওয়ার্মহোল স্পেসের বুকে ঠিক এই কাজটিই করে। স্পেসকে সে এমনভাবে বেঁকে ফেলে যে দুইটা বিশাল বিশাল দূরত্ব রীতিমতো শূন্য হয়ে যায়। অর্থাৎ সেটা সময় এবং কালকে অতিক্রম করে যেতে পারে। কার্ল সেগান যথার্থই বলেছিলেন ওয়ার্মহোলের ব্যাপারে – ‘You might emerge somewhere else in space, some when-else in time’।
এবার আমরা ফিরে যাই দুই ঘাড়ত্যাড়া থিওরির প্রসঙ্গে। এই দুই যুগান্তকারী থিওরির মিলিতকরণ সমীকরণ অদ্ভুত রকমের সরল – ER = EPR। অতি আনন্দের ব্যাপার হলো এটা এতোটাও সরল না যে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে হবে এটা ভেবে যে এই সামান্য কয়েকটা অক্ষর তো আমার মাথায়ও আসতে পারতো! এগুলো আসলে সংখ্যাগত কোনো মান নয়। এগুলো দুইটা সায়েন্টিফিক পেপারের কথা বলছে। প্রথমটা হল আইনস্টাইন-রোজেন পেপার আর পরেরটা হল আইনস্টাইন-রোসেন-পোডলস্কি পেপার আর দুটোই ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত। প্রথমটা ওয়ার্মহোলের বর্ণনা দেয়। যাকে টেকনিক্যালি ডাকা হয় আইনস্টাইন-রোসেন ব্রিজ নামে। আর পরেরটা কোয়ান্টাম এনট্যাংগলমেন্ট এর বর্ণনা দেয়। ওয়ার্মহোল সম্পর্কে আগেই বলেছি এবার আসা যাক কোয়ান্টাম এন্টাংগলমেন্ট প্রসঙ্গে।
কোয়ান্টাম জগতের সবচেয়ে জাদুকরী কয়েকটা কনসেপ্টের মধ্যে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট অন্যতম। এটা বলে যে কোয়ান্টাম জগতে দুটো পার্টিকেল এমনভাবে পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে যে তারা সবকিছু একই সাথে করতে পারে যেন তারা তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত শেয়ার করছে। অর্থাৎ প্রথম পার্টিকেল যদি ডানে ঘুরে যায় দ্বিতীয়টা সাথে সাথে বামে ঘুরে যাবে এক বিন্দুও সময় নষ্ট না করে। আরও মজার ব্যাপার হল দুটোর মাঝখানের দূরত্ব কোনো ব্যাপারই না। দুটো যদি মহাবিশ্বের দুই প্রান্তেও থাকে তবুও ঘটনাটি ঘটবে এবং কোনো সময় নষ্ট না করেই!
এবার ফিরে আসা যাক বর্তমান কালে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির লিওনার্ড সাসকিন্ড আর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির হুয়ান মাল্ডাসেনা এই দুই ঘটনাকে একত্র করেছেন একটি পেপারে। তারা পেপারে একটি কাল্পনিক দৃশ্য কল্পনা করেছেন যেখানে অ্যালিস আর বব নামক দুইজন এরকম একজোড়া এনট্যাঙ্গলড পার্টিকেলের একটা একটা নিয়ে হাইপারসেনিক নভোযানে চড়ে মহাবিশ্বের দুই প্রান্তে চলে যায়। তারপর তারা পার্টিকেলগুলোকে এতো জোরে আঘাত করে যে তারা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। যেহেতু পার্টিকেল দুটো এনট্যাঙ্গলড সেহেতু ব্ল্যাকহোল দুটোও একটা বিশাল ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ তারাও এখন এনট্যাঙ্গলড ব্ল্যাকহোল। এর ফলে কী হবে, আমরা এখন রিলেটিভিটির উপাদান ওয়ার্মহোলের জ্যামিতি বা বৈশিষ্ট্য ব্যাবহার করে এন্ট্যাঙ্গলমেন্টকে ব্যাখ্যা করতে পারবো যা সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম জগতের চরিত্র। এবং মজার ব্যাপার হল এমনও হতে পারে যে এন্ট্যাঙ্গলড পার্টিকেলগুলোও আসলে কোয়ান্টাম ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত! সাসকিন্ড একারণেই বলেছেন – ‘Since wormholes are contortions of spacetime geometry – described by Einstein’s gravitational equations – identifying them with quantum entanglement would forge a link between gravity and quantum mechanics.’
ব্যাপারটা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ বিজ্ঞান শুধুমাত্র অনুমানের ওপর বিশ্বাস করে না। অনেক অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে থিওরিটাকে যেতে হবে। তবে অন্তত শুরু করা গিয়েছে এটাই আনন্দের ব্যাপার। আশাতেই বসতি!