আধুনিক যুগে পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বীয় জগতের ডন যদি হন আইনস্টাইন, তাহলে মধ্যযুগে সেই ডন ছিলেন নিউটন। ঠিক তেমনি ফলিত বিজ্ঞানের আধুনিক যুগের ডন যদি হন নিকোলা টেসলা, তাহলে মধ্যযুগে সেটা ছিলেন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’। বস্তুতপক্ষে, টেসলার সাথে ভিঞ্চির মিল অসাধারণ! দুজনেই ছিলেন শিল্পের ভালো সমঝদার (ভিঞ্চি ছিলেন দুর্ধর্ষ চিত্রশিল্পী আর টেসলা ছিলেন দুর্ধর্ষ কবি)। দুজনেই ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। দুজনেই অন্য কারো কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া ব্যতিরেকেই, প্রায় শূন্য হতে ম্যাজিকের মত আইডিয়া মাথায় এনে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সক্ষম ছিলেন। দুজনের কাছেই বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্ররা ছুটে গিয়েছিলো অলৌকিক সব ক্ষমতা পাবার উদ্দেশ্যে (ভিঞ্চির নিকট গিয়েছিলো কিংবদন্তীতুল্য এক অ্যাসাসিন, আর টেসলার নিকট গিয়েছিলো কিংবদন্তীতুল্য এক ম্যাজিশিয়ান)। দুজনেরই সব আবিষ্কারের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে আমাদের, সৃষ্টির সেরা বুদ্ধিমান প্রাণীদের, মোটামুটি ১০০ বছরের মত সময় লেগে গেছে।
দুজনের মাঝে এত এত মিল দেখে যখন আমরা বিজ্ঞানযাত্রা হতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ‘নিকোলা টেসলা’ কে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের একটা প্রিকুয়েল (Prequel) নামাতে, যেখানে মূলনায়ক থাকবেন মধ্যযুগের আবিষ্কারকদের ডন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’, তখন আমাদের চোখ পড়লো ভিঞ্চির কিছু আবিষ্কারের দিকে। আর আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম টেসলার সাথে এখানেই ভিঞ্চির সবচেয়ে বড় ফারাক। টেসলা যদি হন বন্ড মুভির ‘কিউ’, তাহলে ভিঞ্চি হচ্ছেন সেই মুভির পুরাদস্তুর একজন বন্ড ভিলেন। মধ্যযুগে ইউরোপে যদি ‘এমআই-সিক্স’ এর অস্তিত্ব থাকতো তবে তারা এজেন্ট ‘জিরো জিরো সেভেন’ কে লেলিয়ে দিতো ভিঞ্চির পেছন পেছন।
কারণ জানতে চান? তাহলে তাকান নিচে ভিঞ্চির বিভিন্ন আবিষ্কারের আইডিয়ার মাঝে-
১। অসাধারণ রকমের এক দুর্ভেদ্য দুর্গ
বন্ড ভিলেন হবার প্রথম শর্ত হচ্ছে এটা। ভিলেন তার মাস্টারপ্ল্যান বানাবে তার নিজস্ব এক গোপন দুর্গে বসে (যদিও বন্ড সিরিজের সর্বশেষ কিছু পর্বে এই ধারণাটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে)। এই দুর্গে অনুপ্রবেশের চিন্তা করা দূরের কথা, মোটামুটি মাইল দুয়েকের ভেতর যাবার চেষ্টা করলেই বেঘোরে মারা পড়তে হবে। ভিঞ্চিও তৈরি করেছিলেন এমন এক দুর্গের ডিজাইন যেটায় হাল আমলের এমআই সিক্স এজেন্টের অনুপ্রবেশ করতেও রীতিমত ঘাম ছুটে যাবে।
ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
‘সান জু’ তার লিখিত ‘আর্ট অব ওয়ারে’ বলেছিলেন, “অজেয়তা নিহিত আছে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধে, এবং বিজয়ের সম্ভাবনা আছে আক্রমণে”। অর্থাৎ আক্রমণে জয়-পরাজয় সবই ঘটতে পারে। কিন্তু যে প্রতিরোধ সহজে ভেঙ্গে পড়েনা, সেটা সবসময়ই অজেয়। লিওনার্দো তার নিজের জীবনেও এই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ কর্তৃক কন্সট্যান্টিনোপল দখল হবার আগের বছর তিনি জন্মেছিলেন। রেনেসাঁ যুগের যুদ্ধকৌশল এবং রাজনীতির প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। তিনি নিজ চোখে দেখেছেন এক মাইল দূর হতে ছোঁড়া সুলতান মাহমুদের কামানের গোলাগুলোর সামনে কীভাবে তথাকথিত দুর্ভেদ্য সব দুর্গ হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ে।
টার্কিশ কামানের সামনে যখন মধ্যযুগীয় দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দফারফা হয়ে গেলো, তখন ভিঞ্চির মত সামরিক পরিকল্পনাবিদদের হাতে পড়লো এদের নিরাপত্তা বর্ধনের দায়িত্ব। অনেকেই অনেক রকমের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। যেমন- কেউ প্রস্তাব করলেন দুর্গের বাইরে চার-পাঁচ স্তরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের। কেউবা বললেন শুধু চার-পাঁচ স্তরের দেয়াল বানালেই হবে না, সেগুলোকে আরো উঁচু করে বানাতে হবে- যাতে কামানের গোলা দুর্গের দেয়াল টপকে সরাসরি ভেতরে এসে আঘাত হানতে না পারে। কেউ কেউ আবার প্রস্তাব করেছিলেন- ভুয়া একটা দুর্গ বানিয়ে সেটার ভেতরে আরেকটা আসল দুর্গ বানাতে। দুই দুর্গের মাঝে হাজারে হাজারে তেলের ড্রাম রাখা হবে। যখন শত্রুরা ভুয়া দুর্গে ঢুকে পড়বে, তখন আসল দুর্গের প্রতিরক্ষাকারীরা সেসব তেলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে দিবে- ইত্যাদি ইত্যাদি এমন আরো অনেক ধরনের পরিকল্পনা।
কিন্তু সব ধরণের পরিকল্পনাতেই বড় রকমের খুঁত ছিলো। চার-পাঁচ স্তরের দেয়াল দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী বানাতে গেলে দুর্গের চারপাশে বিশাল জায়গার প্রয়োজন হবে। অনেক সময় সেটা পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আগেই বলেছি তুর্কিদের কামানের গোলা মাইল খানেক দৌড়াতে সক্ষম। তাতে ফলাফল কতটা আশাব্যঞ্জক হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর তেলের ড্রাম থিওরিতে গেলে তো ফলাফল আরো ভয়াবহ। বাইরের শত্রুদের নকল দুর্গের ভেতর আটকে ফেলে চারপাশে আগুন ধরিয়ে দেয়া না হয় গেলো, কিন্তু ভেতরের আসল দুর্গের লোকদের পালানোর প্রয়োজন পড়লে তখন কি হবে? যদি অন্যান্য দুর্গের মত এটায়ও গোপন টানেল ধরেই পালাতে হয়, তাহলে দুর্গের এত নিরাপত্তার আর প্রয়োজন কী?
তাই ভিঞ্চি তৈরি করলেন তার নিজস্ব দুর্গের নকশা– যেটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা দখল করে না, অন্যান্য দুর্গের কিংবা প্রাসাদের চেয়েও বেশী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে (যেমন- প্রতিরক্ষাকারী কামান, তীরন্দাজ ইত্যাদির সুকৌশল অবস্থান গ্রহণ) সমর্থন করে এবং একই সময়ে এর দেয়াল কামানের গোলার তীব্র ধাক্কা হজম করতে পারে।
কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
আপনারাই দেখুন আর বিচার করুন।
যদি এটাকে হলিউডি সাই-ফাই মুভির দৃশ্য হতে উঠে আসা কোন ফিউচারিস্টিক স্থাপত্যকলার নিদর্শনের মত না মনে হয়, তাহলে বলবো আপনার আরো বেশী করে ‘স্টার ওয়ার্স’ মুভিগুলো দেখা উচিৎ (আধুনিক তিনটা প্রিকুয়েল বাদ দিয়ে। ওগুলো হচ্ছে পরিচালক জর্জ লুকাসের ‘স্টার ওয়ার্স’ সিরিজকে সম্ভ্রমহানি করার ফলে সৃষ্ট তিনটা অবৈধ সন্তান)। এটা যদি একজন বন্ড ভিলেনের নিখুঁত দুর্ভেদ্য আস্তানা না হয়, তবে আমাদেরও ধারণা নেই সেটা আর কীভাবে হতে পারে।
কামানের গোলার কার্যকারিতা কমাতে এক পর্যায়ে মধ্যযুগের বিভিন্ন দুর্গ এবং প্রাসাদের দেয়াল চক্রাকারে বানানো শুরু হয়েছিলো। এতে পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। কিন্তু কামানের গোলার বিরুদ্ধে আরেকটু বেশী ঘাতসহ হয়ে উঠেছিলো এগুলো। ভিঞ্চি সেই ধারণাটাকেই আরো বহুদূর নিয়ে গিয়েছিলেন এই অতি ফিউচারিস্টিক এক স্থাপত্য নকশায়।
কিন্তু কথা হলো, সেই গোপন আস্তানায় আমাদের এই বন্ড ভিলেন কী এমন গোপন জিনিস তৈরি করবেন? অনেক কিছু, যেগুলো দিয়ে পুরো দুনিয়ার ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়। যেমন- প্রথমত বলা যায়……….
২। রোবট আর্মি
রোবটের ধারণাকে যত আধুনিক মনে করা হয় আসলে সেটা তত আধুনিক নয়। বরং খ্রিস্টের জন্মেরও ২৭০ বছর আগে গ্রীক প্রকৌশলী ‘টেসিবিয়াস’ মানবসভ্যতাকে রোবট সম্পর্কে ধারণা দেন। কিন্তু সেই রোবটকে আরো আধুনিকায়ন করে ‘ড্রোন আর্মি’ বানিয়ে তাদের যুদ্ধের ময়দানে ছেড়ে দেয়ার আইডিয়াতো সাম্প্রতিক কালের ঘটনা, ঠিক না? না, ভুল! আধুনিক মানুষদের মাথায় এই আইডিয়া আসার আরো বহু শতাব্দী পূর্বেই ভিঞ্চি এই ‘ড্রোন আর্মি’ বানানোর পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন।
ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
ইতালিয়ান সামরিক বাহিনী যে সব অপদার্থদের সমন্বয়ে গঠিত, এই তথ্য মধ্যযুগীয় দার্শনিক এবং রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ‘নিকোলো মাকিয়াভেল্লি’ এর চেয়ে ভালো আর কেউ জানতো না। তার ‘দ্যা ডিসকোর্সেস’ এবং ‘দ্যা প্রিন্স’ পুস্তকসমূহের জায়গায় জায়গায় তিনি মোটামুটি ঘুরেফিরে এই কথাই বলেছেন যে- ইউরোপের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে তার নিজের সৈন্যদের কামান হতে ছোঁড়া গোলায় নিজেরাই ধরাশায়ী হয়ে। আধুনিক যুগেও ইতালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাকিয়াভেল্লির এই বক্তব্য সমানভাবে প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ- ইতালি বনাম ইথিওপিয়ার যুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালেই হয়।
যাই হোক, এই ব্যাপারে সেই সময়ে ইতালির সমস্যা ছিলো দ্বিমুখী। প্রথমত, তখনো ইতালি একত্রিত হয়ে একটি সঙ্ঘবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে নিজস্ব ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ সেনাবাহিনীও গড়ে উঠেনি। দ্বিতীয়ত, ইতালির ডিউক এবং যুবরাজেরা বহির্দেশের, বিশেষত সুইজারল্যান্ডের, ভাড়া করা সৈন্যদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ইতালির অর্থ-সম্পদের এক বিশাল অংশই ব্যয় হতো এই ভাড়া করা সৈন্যবাহিনীর খরচ যোগাতে। কিন্তু তাতেও সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই ভাড়া করা সৈন্যরা মাঝে মাঝেই মোটা টাকার বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিপরীত শিবিরে যোগ দিতো। তথ্য পাচার করতো।
এই সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে এলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি মানুষের শরীরের পেশী এবং সেসব পেশীর চলনের নেপথ্যের সব মেকানিক্যাল প্রসেসগুলো নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন সহকারে। এখনকার রোবটিক্সের জগতের দুর্ধর্ষ সব চিন্তাবিদেরাও স্বীকার করেন ভিঞ্চি ঠিক পথেই আগাচ্ছিলেন। তিনি প্রায় নিখুঁতভাবে উদ্ধার করেন মানবশরীরের বিভিন্ন পেশীর নড়ন-চড়নের পেছনের সব নেপথ্য কারিগরদের রহস্য। এরপরে কাজ ছিলো একটাই। যন্ত্রপাতির কলাকৌশল ব্যবহার করে সেই একই প্রক্রিয়াগুলো একটা যন্ত্রমানবের ভেতরে ঘটানো। তিনি এই লক্ষ্যে কিছু ডিজাইনও প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়কার প্রযুক্তিগত অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি তার ডিজাইনগুলোকে আর বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হননি।
কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
ভিঞ্চির ডিজাইন করা রোবটেরা বর্তমান বাজারের ড্রয়েডদের থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলো- একথা সত্যি। কিন্তু ভিঞ্চির চিন্তাধারা সঠিক পথেই চলছিলো এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তার রেখে যাওয়া ডিজাইন অনুসরণ করে বর্তমানে যে রোবট দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা মানুষের মতই হাত-পা নাড়াতে এবং চলাফেরা করতে পারে।
তার কাগজে অংকিত রোবটেরা বর্তমানের বদলে সেই আমলেই মানুষের মত চলতে ফিরতে সক্ষম হতো যদি তিনি তাদের চালাতে একটা নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎসের সন্ধান পেতেন। যদি সেই আমলে বৈদ্যুতিক মোটর কিংবা নিদেনপক্ষে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ধারণাও চালু থাকতো, তাহলে বর্তমানের মানুষদের ‘স্কাইনেট’ এর শাসনাধীনে থাকাটাও বিচিত্র কিছু ছিলো না। তবে এটুকু অন্তত বলা যায়, মাকিয়াভেল্লিকে সেইসব মডেল রোবট আর বাস্তবের ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর মধ্য হতে বাছাই করতে বললে তিনি পূর্বেরটাকেই সমর্থন দিতেন যুদ্ধের ময়দানে নামানোর জন্যে।
৩। ট্যাংক
আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সদের দুই লক্ষ বছরের মারামারি-কাটাকাটির ইতিহাসে ট্যাংক এক নব সংযোজন। ট্যাংককে বলা হয় যুদ্ধের ময়দানের রাজা। আর যুদ্ধ যদি না চলে, তবে অবসরে জনবসতিতে ট্যাংক নিয়ে ঢুকে পড়ে মানুষকে ভয় দেখানোর মত আনন্দেরও কোন তুলনা নেই। উপরের তিনটি বাক্যের মধ্যে একটা হচ্ছে আংশিক ভুল। কোনটা ধারণা করুন তো! যারা বলছেন “তৃতীয়” তাদের বলবো আপনারা জীবনে একবার হলেও ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো’ খেলার চেষ্টা করে দেখুন, আর যাচাই করুন তৃতীয় বাক্যের সত্যতা (সেই সাথে উপরের ঐ বাক্যের লিংকগুলোও চেক করুন)। যারা বলছেন “প্রথম”, তারাই আসলে সঠিক। কিন্তু প্রথম বাক্যের কোন অংশটা মিথ্যা? “হোমো স্যাপিয়েন্সদের দুই লক্ষ বছরের মারামারি-কাটাকাটির ইতিহাস”?
না, তা নয়। ভুল হলো “ট্যাংক এক নব সংযোজন” এর অংশটা। ভিঞ্চি বহু শতাব্দী আগেই ট্যাংক আবিষ্কার করে গেছেন।
ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
মানুষের অভ্যাসই হলো সব কিছুকে পোর্টেবল সাইজে নিয়ে আসা যাতে সে বস্তুটাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে পারে। সেটা আগের আমলের টু-ব্যান্ড রেডিও কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারকে সস্তা চায়না মোবাইলের ভেতরে ঢুকিয়েই হোক, কিংবা জন সুবিধার্থে টয়লেট নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ানোই হোক। আগের পয়েন্টে বর্ণিত মধ্যযুগীয় কামানগুলোও দেখা গেলো একই পরিণতির দিকে আগাচ্ছে। তারা দিনকে দিন পোর্টেবল সাইজের হয়ে যাচ্ছে, অথচ তাদের ক্ষমতা বাড়ছে বৈ কমছে না। কিন্তু একটা ব্যাপারে এগুলোর দুর্বলতা তখনো রয়ে গেছে। কামানগুলোকে যারা পরিচালনা করছে তাদের মেরে ফেললেই কামানগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।
ভিঞ্চি যথারীতি এগিয়ে এলেন তার মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে। তিনি কামানটাকে খোলের মত আবরণে ঢেকে ফেললেন। অনেকে হয়তো ভাবছে- এ আর এমন কী ব্যাপার? ‘ব্যাটারিং র্যাম’ এর ক্ষেত্রেও তো এমন করা হয়েছিলো। তাহলে আরেকটু পড়ুন। ভিঞ্চির ডিজাইন করা ট্যাংকগুলো ৩৬০ ডিগ্রীর পুরোটা জুড়েই কার্যকর ছিলো, যেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংকের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি।
কিন্তু মূল ঘটনা সেটাও নয়। ঘটনা হলো আপনি এটার ৩৬০ ডিগ্রী ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতর দিয়ে কোনরকমে গা বাঁচিয়ে কাছাকাছি পৌঁছে ট্যাংকটার ঢাকনি উপড়ে ফেললেন, আর প্রস্তুতি নিলেন ভেতরে থাকা সবাইকে কচুকাটা করার। কিন্তু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন ভেতরে কেউ নেই, এটা নিজে নিজেই চলছে!
কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
লিওনার্দো যখন দেখলেন কামানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা, তিনি তখন তার ডিজাইনে সেই ব্যক্তিদেরই সরিয়ে দিলেন। ঘোড়ায় টেনে সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থাও স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা হলো তার ডিজাইনে। গিয়ার-পুলি মেকানিজমের মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে এটা নিজে নিজেই ফায়ার করতে থাকে।
আধুনিক যুদ্ধ-তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায় ভিঞ্চির এই ট্যাংকের ডিজাইনের অনেক ত্রুটি পাওয়া গেছে। তবে সামরিক কলা-কৌশল বিদেরা স্বীকার করেছেন ভিঞ্চির আইডিয়া হতেও আধুনিক যুগের ট্যাংক অনেক অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। কিন্তু পিলে চমকে উঠার ব্যাপার হলো, সম্প্রতি কালে ভিঞ্চির আরো কিছু গবেষণার নকশা খুঁজে পাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন- পূর্বে ট্যাংকের ডিজাইনে খুঁজে পাওয়া ত্রুটিগুলো ছিলো আসলে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো! ভিঞ্চি নিজেই তার ডিজাইনগুলো এইভাবে ত্রুটিযুক্ত করে রেখে গেছেন। তার মূল চেষ্টা ছিলো এইসব ডিজাইন অন্য কারো হাতে যাতে না পড়ে। আর পড়লেও যাতে সেটা হতে কোন সুবিধা আদায় করতে না পারে।
তাহলে কি সত্যি সত্যিই তার ডিজাইন করা মনুষ্যবিহীন মূল ট্যাংকগুলো নিখুঁত রকমের কার্যকর ছিলো?
(চলবে)