ভাইরোলজি পাঠশালা ২.১ : জিকা ভাইরাস

সম্প্রতি জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব (২০১৫) বিশ্ববাসীকে তথা স্বাস্হ্য খাতে কর্মরত মানুষজনকে উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। যারা ইমার্জিং ডিজিজ বা আকস্মিক আবির্ভূত রোগ (এর সহজ বাংলা জানি না) এর সেক্টর বা ক্ষেত্রে কাজ করছেন তারা এই রোগটিকে স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন (ভাইরাসের সংক্রমণের প্রকৃতি এবং বাহকের উপস্হিতি ইত্যাদি চিন্তা করে)। সংক্ষেপে জেনে নেই জিকা ভাইরাস কী।

জিকা ভাইরাস:
জিকা ভাইরাস হচ্ছে ফ্লাভিভিরিডি ফ্যামিলির একটি ভাইরাস (ভাইরাসের নামানুকরণ হিসেবে)। এই ফ্যামিলির ভাইরাসে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আরএনএ জীনোমধারী, এনভেলপড(আবদ্ধ), অতিমাত্রায় ক্ষুদ্র(প্রায় ৪০ নেনোমিটারের কাছাকাছি আকার) ভাইরাস। এই ফ্যামিলির অধিকাংশ ভাইরাস কীট-পতঙ্গ(আর্থোপোড) দ্বারা বাহিত হয়, তাই এদের অনেকে আরবোভাইরাস শ্রেণীতেও ফেলা হয়। সহজে বুঝতে হলে, জিকা ভাইরাস পরিচিত ডেঙ্গু ভাইরাসের সাথে অনেক অনেক মিল। এত মিল যে, একে চিহ্নিত করার কৌশলে অনেক সময় ভুল হয়ে যায় (ক্রসরিএকটিভিটি)। জিকা ভাইরাসও মশার( যেমন এডিস ইজিপ্টি) মাধ্যমে ছড়ায়। জিকা ভাইরাস আক্রান্ত হলে সাধারণত অত ভয়াবহ কোন লক্ষণ আগে দেখা যায় নি। জ্বর, রেশ, হাড়ের জয়েন্টে ব্যাথা বা চোখে লাল দাগ ইত্যাদি লক্ষণ যা অধিকাংশ সময় আক্রান্ত ব্যক্তি উপলব্ধিও করে না। ২০০৭ সালের কিছু আলাদা প্রাদুর্ভাবে স্নায়ু-পক্ষাঘাত সম্পর্কিত রোগ গুলিনবারি রোগের প্রকোপ পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এর কারণ বের করা সম্ভব হয় না। (কারণ গুলিনবারি রোগ অনেক কিছুর সাথেই সম্পর্কিত যা আসলে রোগ না বলে সিন্ড্রোম বলা হয়)। সম্প্রতি ব্রাজিলে গর্ভবতী মায়েদের মাইক্রোসেফালি(অস্বাভাবিক মাথার আকার(ছোট) নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু) রোগাক্রান্ত বাচ্চা প্রসবে জিকা ভাইরাসের সরাসরি সংযোগ পাওয়ায় ডাব্লিউএইচও(হু= বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা) জিকা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করে।
জিকা ভাইরাসের ইতিহাস এবং প্রাদুর্ভাব:
উগান্ডার জিকা জঙ্গলে পাঠানো গবেষণার কাজে নিয়োজিত বানর (রিসাস মাকাক) থেকে ১৯৪৭ এ প্রথম এই ভাইরাস পাওয়া যায় (আইসোলেশন)। এই ভাইরাস নিয়ে খুবই কম গবেষণা রয়েছে যেহেতু এটি অত বড় ধরণের প্রাদুর্ভাব এবং রোগের লক্ষণ অতটা ভয়ঙ্কর ছিলো না (আগের প্যারায় বলেছি আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় অজ্ঞ থাকে)। প্রথম জিকা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৫৩ তে, যদিও ১৯৫২ থেকে ১৯৬৩ তে বিভিন্ন গবেষনায় এশিয়া এবং আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মানুষের রক্তে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার প্রমাণ মিলে (সেরোপ্রিভেলন্স গবেষণা)। ২০০৭ এ মাইক্রোনেশিয়া এবং ইয়াপ রাস্ট্রের কিছু দ্বীপে প্রায় ৫০০০ জনের মতো আক্রান্ত হয়; পরবর্তীতে ২০১৩-১৪ তে ফরাসি পলিনেসিয়াতে প্রায় ৩২০০০ এর মানুষকে জিকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কিনা পরীক্ষা করা হয়। ২০১৪ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপে, ক্যম্বোডিয়া এবং পরে এশিয়াতে বিভিন্ন দেশে সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০১৫ (মার্চ) তে আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বাহিয়াতে প্রথম পাওয়া যায়। এক বছরে (মার্চ, ২০১৫ থেকে মার্চ, ২০১৬) ব্রাজিলে প্রায় ৫১ হাজারের উপরে সম্ভাব্য জিকা ভাইরাস আক্রান্ত হয় এবং আমেরিকা মহাদেশের প্রায় ৩৩ টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ এর সেপ্টেম্বর থেকে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত এলাকায় মাইক্রোসেফালি আক্রান্ত শিশু জন্ম লক্ষ্য করেন যার সংখ্যা ২০১৬ এর ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়ায় প্রায় ৪৩০০ জনে। পূর্বের প্রাদুর্ভাবে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত এলাকায় জন্মগত ত্রুটি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো যার মধ্যে মাইক্রোসেপালি ছিলো। পরবর্তীতে দেখা যায়, জিকা ভাইরাস মা থেকে শিশুতে এবং যৌনক্রিয়া বা সেক্সের মাধ্যমেও ছড়ায়। যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় আক্রান্ত হবার ব্যাপারে অজ্ঞ থাকে এবং ভাইরাসে সংক্রমণের প্রকৃতির পরবর্তীতে শিশুতে এর প্রভাব সব মিলিয়ে জিকা ভাইরাস বড় এক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই সিদ্ধান্তে আসা হয়, জিকা ভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এক ল্যাব আরেক ল্যাবকে বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশ করার আগেই আদান-প্রদান করতে পারবে।
জিকা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়:
১. মশার মাধ্যমে:
জিকা ভাইরাস কিভাবে জঙ্গল থেকে লোকালয়ে আসে তা বুঝতে হলে, সিলভাটিক বা এনজুটিক চক্র (সাইকেল) বুঝতে হবে। সহজে বললে, কোন জীবাণু যা বন্য প্রাণী( যেমন বানর) ও বাহক(মশা) এর মধ্যে জীবন চক্র সম্পন্ন করে। এখানে বলে রাখা ভালো, জুনসিস এর সাথে এটাকে মিলিয়ে ফেলবেন না। এখন জিকা ভাইরাস জঙ্গলে বাসকারী মশা(যেমন এডিস আফ্রিকানাস) থেকে বানরে ছড়ায়, আবার বানর থেকে মশা, মশা থেকে বানর এই চক্রে থাকে- এটাকে বলে সিলভাটিক বা জঙ্গল চক্র। এখন, কোনো মানুষ যদি দুর্ঘটনাবশত জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মশার কামড় খায়, তাহলে তার রক্তে জিকা ভাইরাস চলে আসবে। এই মানুষ যখন লোকালয়ে আসবে, তখন লোকালয়ে বাসকারী মশা (যেমন এডিস ইজিপ্টি) যদি তাকে কামড় দেয় ঐ লোক থেকে মশায় জিকা ভাইরাস যাবে, ঐ মশা আরেক মানুষে ছড়াবে, সেখান থেকে নতুন মশায় এই ভাবে চক্র চলবে- এইটাকে লোকালয়/মফস্বল চক্র (সাবআরবান-আর্বান সাইকেল) বলে। এখন আপনি বলতে পারেন, জঙ্গলের মশা কি লোকালয়ে আসতে পারে না? একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির মশা নির্দিষ্ট পরিবেশ এর সাথে খাপ খাইয়ে অভিযোজিত(ইভোলভড) হয়, তাছাড়া এরা তাপমাত্রা এবং পশুর (অ্যানিমাল- বিজ্ঞানের ভাষায় মানুষও একই) উপস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই জঙ্গলের প্রজাতির লোকালয়ে আসা সম্ভবনা কম, তাছাড়া লোকালয়ে অনেক মশার প্রজাতি রয়েছে। নতুন পরিবেশে নতুন প্রজাতি নতুন প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে যেখানে জঙ্গল থেকে আসার মশার বাঁচার সম্ভাবনা কম। আর মশা বেশিদিন বাঁচেও না। জিকা ভাইরাস লোকালয়ে এ.(এডিস) ইজিপ্টি, এ. এল্বোপিকটাস, এ. হেনসিলি, এ. পলিনিয়েনসিস ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। এ. ইজিপ্টি ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য বিখ্যাত (খারাপঅর্থে)। এই মশার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশেও আছে। এ. এল্বোপিকটাস বাংলাদেশে কি কেমন আছে, তা ঠিক জানি না। তবে এই মশা কিন্তু এশিয়াতেই প্রথম দেখা যায়, যেখানে এ. ইজিপ্টি আফ্রিকাতে প্রথম দেখা যায়। তাপমাত্রা, পরিবেশ, বৃষ্টি, জনসংখ্যা, ভাইরাস নির্ণয়ের ব্যবস্হার সুযোগ কম থাকা ইত্যাদি বাংলাদেশকে জিকা ভাইরাস আক্রান্তের ঝুঁকিতে ফেলে। (একজন পাওয়া গিয়েছিল এমন একটা খবর দেখেছিলাম)
২. মশা ব্যতিরেকে:
ক. মা থেকে শিশুতে: জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মায়ের অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি (আরএনএ নির্ণয়) দেখা গেছে যেখানে আল্ট্রাসনোগ্রামে গর্ভের বাচ্চা মাইক্রোসেপালি আক্রান্ত নির্ণিত হয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক গবেষণায়, জরায়ুতে অবস্হানকারী বিশেষ কোষ (প্লাসেন্টাল মেক্রোফাজ) জিকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে প্রমাণিত হয়েছে। ইঁদুর এবং স্টেমসেলভিত্তিক ব্রেন-অর্গানয়েড(নিউরোস্ফোর) মডেলে দেখা যায়, জিকা ভাইরাস সংক্রমণ মাইক্রোসেফালির লক্ষণ প্রকাশ করে।
খ. যৌনক্রিয়া বা সেক্সের মাধ্যমে: আক্রান্ত পুরুষ থেকে নারীতে সংক্রমণের ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে। অর্থাৎ আক্রান্ত পুরুষ যার(পুরুষ/নারী) সাথে যৌনক্রিয়া বা সেক্স(অনিরাপদ/কনডম ব্যাতিত) করবে তার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া জিকা ভাইরাস গবেষণার জন্য ব্যবহৃত ইদুর এর মডেলে ইদুর(আইএফএনআর-/-) শুক্রাশয়ে জিকা ভাইরাস এর উপস্হিতি দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন কেস রিপোর্টানুযায়ী আক্রান্ত হবার অনেক দিন পরেও রোগের লক্ষণ না থাকলেও এই ভাইরাস বীর্য এবং পস্রাবে উপস্হিত থাকতে পারে। তবে নারী থেকে পুরষের ঘটনা এখনো জানা যায় নি।
গ. রক্ত সঞ্চালনে(!??) এখনো পর্যন্ত এমন ঘটনার হদিস পাওয়া যায়নি, কিন্তু এভাবে ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘ. গবেষণা করতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়া ২০১৫ এর আগে চারটি এমন ঘটনার কথা জানা যায়, যদিও কিভাবে ঘটেছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। ২০১৬ এর জুনে যুক্তরাস্ট্রে একজন এই ভাবে আক্রান্ত হবার খবর জানা গেছে।
(চলবে)
পুনশ্চ:
  • ১. সহজভাবে বোঝানোর জন্য সহজ ভাষায় লিখার চেষ্টা করেছি। অনেক সায়েন্টিফিক টার্ম বাদ দিয়েছি। যথাসম্ভব বাংলায় লিখার চেষ্টা করেছি।
  • ২. আরো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে করতে পারেন বা মেসেজ জানাতে পারেন। জানার জন্য কোন লজ্জা বা ভয় থাকা উচিত না।
  • ৩. বড় পোষ্টের জন্য দু:খিত। আশা করি, অধিকাংশ ভুল ধারণা দূর হবে।
  • ৪. ভুল-ত্রুটি কমেন্টে উল্লেখ করলে খুবই খুশি হবো।
  • ৫. ব্যকরণগত ত্রুটি এবং ভুল শব্দের প্রয়োগ থাকতে পারে।
ধন্যবাদ
মীর মুবাশ্বির খালিদ
ইরাসমাস মেডিকেল সেন্টার, রটারডাম দি নেদারল্যান্ডস

 

Comments

Avatar

mirmkhlaid

I am a postdoctoral researcher (Buck Institute, CA, USA) and did my Ph.D on Molecular Virology (SARS-CoV2 and ZIKV). Previously, background: Genetic Engineering & Biotechnology(BS & MS, DU, Bangladesh); Infection & Immunity (MSc, EUR, Netherlands). I have done research on molecular virology (HIV, Zika, HCV & HBV). My focuses are understanding host-viral interaction, viral evolution and disease modeling. Current research focuses are T-cell metabolism in HIV, and Immune Aging.

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

3 1 vote
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x