ভাইরোলজি ১ || ভাইরোলজি ২ || ভাইরোলজি ৩ || ভাইরোলজি ৪
২০২০ সাল শুরু হয় আমেরিকা-ইরানের উত্তেজনা, অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল, ফিলিপাইনে অগ্নুৎপাতের খবর দিয়ে। সাথে চুপি চুপি আরেকটি ভয়াবহতা অপেক্ষা করছিলো। এই ভয়াবহতা হচ্ছে নতুন এক সংক্রামক রোগ। সংক্রামক রোগ মানবজাতির ইতিহাসে বারবার আক্রমণকারী অপরাজিত শত্রু। নতুন এই সংক্রামক রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী একটি নতুন করোনাভাইরাস। নতুন এই ভাইরাসটির নাম প্রথমে উহান ভাইরাস, পরে নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV) রাখা হয়েছে। পূর্বের সার্স ও মার্স ভাইরাসের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা মনে রেখে ভাইরাসবিশষেজ্ঞ, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই ভাইরাসের উদ্ভব নিয়ে অনেক চিন্তিত এবং সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছেন ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে। বিভিন্ন বিজ্ঞান জার্নাল ও স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য-উপাত্ত থেকে বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে এই প্রবন্ধটি লিখলাম। লেখার শেষে বাছাই করা ২০টি সূত্র রয়েছে। (সূত্র: ১, ৫, ৬, ৭, ১২)
যেভাবে জানা গেল নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV) এর আগমন
প্রতিবছর শীতে মানব ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা ভয়ে ভয়ে থাকে হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়তো করোনাভাইরাসের ছোবল অপেক্ষা করছে। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের হোবেই প্রদেশের উহান এলাকাকে থেকে খবর আসে কিছু অজানা কারণে নিউমোনিয়া আক্রান্ত কিছু রোগীর। নিউমোনিয়ার কারণটি ঠিক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ধরতে পারছিলেন না। তাই ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চীনের সিডিসিকে (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন- রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র) জানায়। উহানের যে এলাকাতে প্রাদুর্ভাব সেটি সামুদ্রিক মাছ-প্রাণী ও জীবন্ত পশু-পাখি বিক্রয়ের বাজারের কাছাকাছি। সেখানে খোলা-মেলাভাবে পশু-পাখির মাংস বেচা-কেনা হয়। ৩১শে ডিসেম্বরে চীনের সিডিসির একদল গবেষক উহানে যায় পরিস্থিতি বুঝতে ও গবেষণার জন্য তথ্য-উপাত্ত-স্যাম্পল আনতে। বুঝতে বাকি থাকে না যে নতুন এক ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই গবেষকরা খুব দ্রুত কাজে নেমে যায় ভাইরাসটির পরিচয় জানতে।
অবশেষে ২০২০ সালে ২৪শে জানুয়ারিতে ড. ওয়েনজি টানের গবেষক দল নেয়জেম (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে) তাদের গবেষণা প্রকাশ করে। গবেষণায় তারা জানায় এটি একটি নতুন করোনাভাইরাস, নাম দেন 2019-nCoV (২০১৯- নোভেল করোনাভাইরাস)। এর আগে এই ভাইরাসটিকে উহান ভাইরাস বলে ডাকা হচ্ছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ভাইরাসের নাম পরে পরিবর্তন হতে পারে (আইসিটিভি ভাইরাসের অফিসিয়াল নাম দিবে)। গবেষণায় জানা যায় এটি করোনাভাইরাসের চারটি গ্রুপের বিটাকরোনাভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত। মানুষকে আক্রান্ত করতে পারা করোনাভাইরাসের বাকি ছয়টি ভাইরাসের সাথে নতুন হিসেবে এই ভাইরাসের আবির্ভাব। (সূত্র: ১, ৬,৭)
তিনজন রোগীর ব্রঙ্কোএলভিউলার লাভাজের তরলে (ফুসফুসের ব্রঙ্কাইয়ের তরল) ভাইরাসে উপস্থিতি পাওয়া যায়। গবেষক দল দাবি করেন যে নোভেল করোনাভাইরাস অজানা নিউমোনিয়া রোগের কারণ হতে পারে। কোকস শর্ত পরীক্ষা প্রমাণ করলে অফিসিয়ালি দাবি করা যাবে যে নোভেল করোনাভাইরাসটিই অজানা নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী।
“নোভেল করোনাভাইরাসই যে উহান প্রদেশে অজানা নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী এটা এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত হয় নি(আর কিছু প্রমাণ বাকি আছে)। কোন জীবাণু দ্বারা একটি সংক্রামক রোগ ছড়াচ্ছে সেটা প্রমাণের জন্য কোকের শর্তগুলো প্রমাণ করতে হয় । যে জার্নাল নোভেল করোনাভাইরাস বৃত্তান্ত পেশ করেছে তারা এখনো সেটা প্রমাণ করে নি। (কোকসের শর্ত পরীক্ষা করতে সময় লাগবে।) (সূত্র: ১ ও ১৫)”
সংক্ষেপে নোভেল করোনাভাইরাস (2019-nCoV)
নতুন করোনাভাইরাস বিটাকরোনাভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত। বিটাকরোনাভাইরাসে আগে প্রাদুর্ভাব করা সার্স ও মার্স করোনাভাইরাস রয়েছে। নোভেল করোনাভাইরাসটি সিঙ্গেল-স্ট্যান্ডেড আরএনএ ভাইরাস, যার জিনোম ২৯, ৯০৩ বেইসপেয়ার। ভাইরাসটির সিকুয়েন্স ১৭ জানুয়ারিতে এনসিবিআইতে জমা দেয়া হয়। করোনাভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে কিছু অজানা তথ্য জানা যায় এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু জানার সুযোগ করে দেয়। (সূত্র: ১,১৯)
লক্ষণসমূহ:
জ্বর, কাশি, নি:শ্বাসে দূর্বলতা/শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা। ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রচন্ড অসুস্থ বা মৃত্যু হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধ ও শিশুদের। সিডিসি পূর্বের মার্স করোনাভাইরাসে অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করেছে আক্রান্ত হবার ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিবে। (সূত্র: ১,২,৩, ৫,৬)
কিভাবে ছড়ায়:
এই মূহুর্তে এটা নিশ্চিত করা যায় নি ঠিক কোন প্রাণী থেকে মানুষে এসেছে। যেহেতু পূর্বের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন বাদুড় থেকে আসতে পারে। বাদুড় আগে প্রাদুর্ভাব করা সার্স ও মার্সের বাহক ছিলো (বাদুড় অনেক ভাইরাস বহন করে নিজে অসুস্থ না হয়ে)। উহান প্রদেশে অনেক খোলা বাজারে জীবন্ত পশুপাখি বিক্রি হয়। অনেকে ধারণা করছেন জীবন্ত প্রাণী সংস্পর্শে (হাতে ধরা, মাংস/রক্ত/মলের সংস্পর্শ, খাওয়া ইত্যাদি) আসার কারণে হতে পারে। যেহেতু পূর্বে সার্স ভাইরাস বাদুড় ও সিভেট বিড়াল ; মার্স ভাইরাস বাদুড় ও উটের সংস্পর্শে ছড়িয়েছে, তাই অনেকে এই ধারণা করছেন। তবে বিশাল সংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তি খোলা বাজারে যাননি, যেটা বুঝায় ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে খুবই সক্ষম (আরএনএ ভাইরাস খুব দ্রুত বিবর্তিত হতে পারে!)। ১৩ জানুয়ারিতে চীনের বাইরে থাইল্যান্ডে একজন চাইনিজ টুরিস্টেকে আক্রান্ত পাওয়া গেছে যে উহান প্রদেশের বাজারে সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। (সূত্র: ২, ৭,৮,৯,১০,২০)
এখনো পর্যন্ত শুধু চীনে মানুষ থেকে মানুষে সম্ভাব্য ছড়ানোর খবর রয়েছে । অন্য যেসব দেশে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে তাদের কাছ থেকে ছড়ানোর খবর পাওয়া যায়নি।
ভাইরাসটি কি বাদুড় বা সাপ থেকে কি এসেছে?
করোনাভাইরাস মানুষ ছাড়াও অন্যান্য স্তন্যপায়ী (যেমন বাঁদুড়, বিড়াল, শুকর, কুকুর, গবাদি পশু, উঠ, খরগোশ), পাখি ও সাপকে সংক্রমণ করে বলে দাবি করা হয়। (সাপের ব্যাপারটা পুরোপুরি নিশ্চিত নই।) বাদুড় করোনাভাইরাসসহ বহু ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত ও বাদুড় থেকে মানুষে বহু ভাইরাসের সংক্রমণের ইতিহাস রয়েছে (যেমন বাংলাদেশে খেজুর রসের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের মৌসুমী প্রাদুর্ভাব), সেই অনুযায়ী কিছু গবেষক ধারণা করেন নতুন এই করোনাভাইরাসটি বাদুড় থেকে আসতে পারে ধারণা করেন। অন্যদিকে একদল গবেষক নতুন এই করোনা ভাইরাসের সাথে অন্য করোনাভাইরাসে জিনোমের বিবর্তনগত বিশ্লেষণ করেন। বিবর্তনগত বিশ্লেষণ ধারণা দেয়ে একটি ভাইরাস কোন প্রজাতি থেকে এসেছে বা অন্য কোন ভাইরাসের সাথে মিল। নতুন এই করোনাভাইরাসটি বাদুড়ের সার্স করোনাভাইরাসের সাথে ৮৫% মিল রয়েছে। অন্য দিকে তারা দাবি করেন নতুন করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন (অন্যতম একটি প্রোটিন যা ভাইরাসকে কোষ আক্রমণে সহায়তা করে) এ হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন হয়েছে করোনাভাইরাসের আরেকটি শ্রেণী/ক্লাড থেকে। পরবর্তীতে তারা ভাইরাসের কোডন ব্যবহার অন্য প্রাণীর সাথে তুলনা করতে গিয়ে সাপের সাথে মিল পান। সেটা থেকে গবেষকরা ধারণা করেন, হয়তো সাপ থেকে মানুষে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়েছে। উহানের ঐ বাজারে সাপও বিক্রি হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। (সূত্র :১,২,৩,৪,২০)
এখানে বলে রাখা ভালো, সাপ থেকে ভাইরাসটি আসা সম্ভাব্য অনুমান. তারা সাপে ভাইরাসে উপস্থিতি দেখাননি বা দেখানোর চেষ্টাও করেননি। ল্যাবে প্রমাণিত করার চেষ্টা ঐ গবেষকরা করেননি। গবেষকদল বিবর্তরগত বিশ্লেষণ ও প্রাদুর্ভাবের তথ্যের সাথে মিল খুঁজে উক্ত সম্ভাব্য সংক্রমণের ধারণা দেন। সাপ থেকে ভাইরাসটি কিভাবে আসবে সেটা নিয়েও কিছু গবেষক সন্দিহান! যেহেতু সাপ হচ্ছে সরিসৃপ ও শীতল রক্ত বিশিষ্ট, তাদের ভাইরাস তাপমাত্রার দিকে সংবেদনশীল আর এদিকে মানুষ হচ্ছে স্তন্যপায়ী ও উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট, নতুন করোনাভাইরাস সাপ থেকে এসে এতো দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারার কথা নয় (যদি আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন ও এভ্যুলুশন অনেক বেশি)। সব মিলিয়ে কোন প্রাণী থেকে এসেছে ও কোন প্রাণীতে ভাইরাসটি প্রকৃতিতে সাধারণত থাকে সেটা নিয়ে এখনো কোন গবেষণা হয়নি।
সাপ খেয়ে কি নোভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে কি?
সাপ খাওয়া থেকে আক্রান্ত হবার নিশ্চিত কোন ঘটনা বিজ্ঞান জার্নাল বা স্বাস্থ্যসংস্থা থেকে জানা নাই (করোনাভাইরাসের কোডন ব্যবহার তুলনা করে সাপের সাথে মিল পেয়েছে)।(সূত্র:৪) যেসব অনলাইন নিউজ পোর্টাল এইখবরটি প্রচার করছে তারা সম্ভবত সূত্র ৩ এর অনুমানকে ‘তিলকে তাল বানিয়েছে’। কোন বিজ্ঞান জার্নাল এখনো এটা নিশ্চিত করেনি পরীক্ষা করে এটি সম্ভব। ভাইরাস নিয়ে গত ৬ বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যথেষ্ট প্রমাণ নেই এবং ঐ জার্নালও দাবি করেনি যে সাপ খাওয়া থেকে ছড়িয়েছে। আমি এটা দাবি করছি না যে অসম্ভব। যেহেতু কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সাপ খাওয়া থেকে ভাইরাস এসেছে সেটার নিশ্চয়তা পাইনি এই লেখা পর্যন্ত। তাই ঐ খবরগুলোকে গুজব বলেই মনে করছি আপাতত। এই লিখা পর্যন্ত কোন বিজ্ঞান জার্নাল সাপ খাওয়া থেকে ভা্ইরাসটি ছড়িয়েছে জানায়নি।
কোথায় ছড়িয়েছে, কতজন আক্রান্ত ও কতজন মারা গিয়েছে?
২৮ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিশ্ব সাস্থ্যসংস্থার সিচুয়েশন রিপোর্ট ৭ (২৮ জানুয়ারি, ২০২০) এর হিসেব অনুযায়ী সর্বমোট ২৭৯৮ জন আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে ২৭৪১ জন চিন দেশের (প্রায় ৬০০০ এর কাছাকাছি সম্ভবত আক্রান্ত)। একই রিপোর্টে ৮০ জন মারা গিয়েছে দাবি করা হয় ।
তবে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সিভিল ও সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অনলাইন জিওলজিকাল ম্যাপে সর্বমোট ৪৪৭৪ জন আক্রান্ত ও ১০৭ জনের মৃত্যু খবর দেয়া হয়। চিনের বাইরে যে দেশগুলোতে ছড়িয়েছে সেগুলো হচ্ছে হংকং, মাকাও, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, মালয়শিয়া, নেপাল, ক্যাম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কোরিয়া (দক্ষিণ), কানাডা, আইভরি কোস্ট, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র। (সূত্র ৯, ১০, ১১)
হিসাবে একটু ভিন্ন হবার কারণ হচ্ছে সিডিসি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের হিসেবে চিকিৎসক ও নিশ্চিত আক্রান্তের হিসেব নেয় যেটা আপডেট বা হালনাগাদ হয় প্রতিদিন। জন হপকিন্সের ক্ষেত্রে রিপোর্ট প্রতি মিনিটেই হালনাগাদ হচ্ছে।
প্রতিষেধক ও টিকা
এখনো কোন প্রতিষেধক (এন্টিভাইরাল) বা টিকা নেই এই ভাইরাসের জন্য। জরুরী অবস্থায় ডাক্তারদের আক্রান্ত ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে বাঁচানোর জন্য পথ্য বা চিকিৎসা দিবার নির্দেশনা দেয়া আছে। এই লেখা পর্যন্ত কোন বিজ্ঞান জার্নাল দাবি করেনি তাদের কাছে সফল ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা রয়েছে। প্রতিষেধক তৈরির জন্য অনেক দেশই কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে কোন দেশই এখনো সফল ভ্যাকসিন তৈরি করেছে বলে কোন বিজ্ঞান জার্নাল বা নির্ভরযোগ্য সূত্র বলে নাই।
কী করা উচিত (সিডিসির উপদেশ)
১. শীতকাল ফ্লু সহ অন্যান্য ঠাণ্ডার (ফুসফুসকে আক্রান্তকারী) ভাইরাসের পৌষমাস! এইসব ভাইরাস ঠাণ্ডাতে খুব সহজে ছড়ায়। তাই ফ্লু এর টিকা নেয়া উচিত।
২. যারা ভ্রমণ করছেন তারা মাস্ক পরিধান করতে পারেন (এন্টিভাইরাল মাস্ক)। এন্টিভাইরাল মাস্কের বাইরের অংশ (সাধারণত নীল) বাইরে থেকে কোন তরল ঢুকতে দেয় না। আর ভিতরের অংশ (সাধারণত সাদা- শোষণের জন্য প্যাড থাকে) যেটি তরল শুষে নিবার ক্ষমতা থাকে। এই ধরণের মাস্ক সাধারণত বাইরের মানুষের হাঁচি-কাঁশির থেকে সুরক্ষা দেয় সাথে আপনার থেকে ভাইরাস ছড়ানোকেও প্রতিরোধ করে।
৩.চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অবশ্যই সচেতন থাকবেন। যেকোন সংক্রামক রোগের কোলেটারাল মৃত্যুর শিকার হোন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা (স্যালুট তাদের!)। রোগীদের দিকে লক্ষ্য রাখুন, নিজে মাস্ক, গ্লাভস, এপ্রন ব্যবহার করুন (এপ্রন কর্মস্থলেই রাখুন- বাসায় নিয়ে আসলে বাসার লোকজনকে আক্রান্ত করার সুযোগ থাকে)।
৪. আপনার হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট বা কাশি শুরু হয়, ডাক্তারের পরামর্শ নিন। অপ্রয়োজনীয় সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকুন যদি অসুস্থ হোন বা কাউকে অসুস্থ দেখেন।
৫. হাত সাবান ও পানি দিয়ে কমপক্ষে বিশ সেকেন্ড ধোবেন। সাবান না থাকলে এলকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন।
৬. হাত না ধুয়ে মুখ, নাক, চোখ ধরা থেকে বিরত থাকুন। যেসব বস্তু বারবার বহু মানুষের স্পর্শ পায় (যেমন দরজার হ্যান্ডল) সেগুলো জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার করুন (সূত্র: ৮)।
কেন বার বার করোনাভাইরাস হানা দিচ্ছে চীন বা অন্য দেশগুলোতে?
করোনাভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক হচ্ছে বাদুর এবং বাদুর থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায়। মানুষ যখন সেসব প্রাণীর সংস্পর্শে(স্পর্শ, মল-মূত্র, খোলা মাংস) আসে তখন সেটা মানুষে ছড়ায়। অপরিষ্কার খোলা বাজারে পশু-পাখি বিক্রয় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই ঝুঁকি। কসাইখানার পরিবেশ যদি জীবাণুমুক্ত বা পরিষ্কার না হলে সহজেই বিভিন্ন জীবাণু ছড়ানোর সুযোগ থাকে। চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খোলাবাজারে প্রক্রিয়াহীন মাংস বিক্রয় হয়। অনেকক্ষেত্রে জীবন্ত প্রাণী (পশু-পাখি) কিনতে চায় ক্রেতা (যাতে বিক্রেতা মৃত বা ভেজাল মাংস না দিতে পারে)। যেকারণে ভাইরাস সক্রিয় থাকা অবস্থায় ক্রেতা-বিক্রেতা ও বাজারে আসা লোকজনে ছড়ানোর সুযোগ থাকে। সেই সাথে সেইসব দেশে জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি থাকায় একজন থেকে আরেকজনে ছড়ানো সুযোগ থাকে। আর এতো মানুষের মধ্যে কিছু লোক থাকবে যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল (যেমন বৃদ্ধ, শিশু ও অন্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি)। দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার লোকদের আক্রান্ত করে ভাইরাস মিউটেশন করে বিবর্তিত হয়ে আরো ভয়ানক হয় ও বেশি ছড়ানোর বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। একই সাথে মানুষের অসেচতনা, ডাক্তারদের কাছে না যাওয়া ও অবহেলা এইরকম ভাইরাস ছড়ানোতে সাহায্য করে। নিচের মিম চিত্রে কৌতুক করে সহজে বুঝানো হয়েছে কিভাবে অপরিষ্কার বাজারে খোলা অবস্থায় পশু-পাখি বিক্রয়ের মাধ্যমে নতুন নতুন ভাইরাস মানুষে প্রাদুর্ভাব করে।
কেমন আছে উহান প্রদেশ?
খুব বেশি খবরাখবর পাওয়া এ মূহুর্তে সম্ভব নয় যেহেতু এলাকাকে কোয়ারেন্টাইন ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে লেভেল ৩ নির্দেশ দেয়া আছে। আটকে পড়া বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে জানা যায়, উহান খুব শুনশান হয়ে গেছে। সবাইকে ঘরে থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়ে। উহানের সাথে বাকিসব এলাকার যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে যাকে বলে লকডাউন। চীনের নববর্ষের (লুনার ইয়ার) জন্য সরকার ও গবেষকরা ভয়ে আছেন। বড় ধরনের লোক সমাগমে যে কোন রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। যদিও সরকার ও ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা উপদেশ দিয়েছেন লোক সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে কতটা কার্যকর হবে সেটা চিন্তনীয়। উহান প্রদেশের ঐ এলাকা স্থবির। আশাকরি এই প্রাদুর্ভাব যেন খুব দ্রুত চলে যায় (সূত্র ১৪)।
“নতুন এই করোনাভাইরাস নিয়ে যতদূর জানি সেটা জানানোর চেষ্টা করলাম। বিজ্ঞান জার্নাল ও নির্ভরযোগ্য সংস্থার তথ্য থেকে নিয়ে লিখেছি। অনলাইন পত্রিকার খবর বাদ দিয়েছি যেহেতু সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা কম।“
ধন্যবাদান্তে
মীর মুবাশ্বির খালিদ
ভিজিটিং গ্রাড স্টুডেন্ট, গ্লাডস্টোন ইন্সস্টিটিউট অব ভাইরোলজি এন্ড ইমিউনোলজি, ইউসিএসএফ, সান ফ্রান্সিসকো, যুক্তরাষ্ট্র।
পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইরাসমাস মেডিকেল সেন্টার, ডি. অব বায়োকেমিস্ট্রি, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি, রটারডাম, নেদারল্যান্ডস।
২৮ ই জানুয়ারি, ২০২০।
কাভার চিত্র: চিত্রটি নেচারের একটি রিপোর্ট থেকে নেয়া। (সূত্র:১৩)
সূত্র/ লিংক:
১. উহানের অজানা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী থেকে নোভেল করোনাভাইরাস আবিষ্কার করা। A Novel Coronavirus from Patients with Pneumonia in China, 2019. Zhu N, Zhang D, Wang W, Li X, Yang B, Song J, Zhao X, Huang B, Shi W, Lu R, Niu P, Zhan F, Ma X, Wang D, Xu W, Wu G, Gao GF, Tan W. (https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMoa2001017) ২. উহানে অজানা নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের নিয়ে কিছু তথ্য। Outbreak of Pneumonia of Unknown Etiology in Wuhan China: the Mystery and the Miracle. Lu H, Stratton CW, Tang YW. J Med Virol. 2020 (https://onlinelibrary.wiley.com/doi/epdf/10.1002/jmv.25678) ৩. নোভেল করোনাভাইরাস বিশ্বের জন্য হুমকি। The continuing 2019-nCoV epidemic threat of novel coronaviruses to global health - The latest 2019 novel coronavirus outbreak in Wuhan, China.Hui DS, I Azhar E, Madani TA, Ntoumi F, Kock R, Dar O, Ippolito G, Mchugh TD, Memish ZA, Drosten C, Zumla A, Petersen E.Int J Infect Dis. 2020. (https://www.ijidonline.com/article/S1201-9712(20)30011-4/pdf) ৪. নোভেল করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের মিল দেখে সাপ থেকে মানুষে সংক্রমণের অনুমান।Homologous recombination within the spike glycoprotein of the newly identified coronavirus may boost cross-species transmission from snake to human.Ji W, Wang W, Zhao X, Zai J, Li X.J Med Virol. 2020. (https://onlinelibrary.wiley.com/doi/epdf/10.1002/jmv.25682) ৫. উহান ভাইরাসের উপর খুব সংক্ষেপে বর্ণনা। Emerging Viruses without Borders: The Wuhan Coronavirus.Liu SL, Saif L.Viruses. 2020 (https://www.mdpi.com/1999-4915/12/2/130) ৬. করোনাভাইরাসের বিভিন্ন গ্রুপ ও তাদের মধ্যকার মিল। Coronaviruses: genome structure, replication, and pathogenesis.Chen Y, Liu Q, Guo D.J Med Virol. 2020 । (https://onlinelibrary.wiley.com/doi/epdf/10.1002/jmv.25681) ৭. করোনাভাইরাসের উদ্ভব ও বিবর্তন নিয়ে নেচার মাইক্রোবায়োলজির চমৎকার একটি রিভিউ। Origin and evolution of pathogenic coronaviruses.Cui J, Li F, Shi ZL.Nat Rev Microbiol. 2019. (https://www.nature.com/articles/s41579-018-0118-9.) ৮. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সিডিসির নির্দেশনা। https://www.cdc.gov/coronavirus/2019-nCoV/infection-control.html ৯. বিশ্বসাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট (২৭ শে জানুয়ারি, ২০২০)। https://www.who.int/docs/default-source/coronaviruse/situation-reports/20200127-sitrep-7-2019--ncov.pdf? ১০. নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে সিডিসির তথ্য: https://www.cdc.gov/coronavirus/2019-ncov/about/index.html ১১. জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির বিশ্বব্যাপী নতুন করোনাভাইরাসের আক্রান্তের বিশ্বমানচিত্র: https://gisanddata.maps.arcgis.com/apps/opsdashboard/index.html#/bda7594740fd40299423467b48e9ecf6 ১২. বিজ্ঞান জার্নাল নেচারে নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ: https://www.nature.com/articles/d41586-020-00209-y ১৩. কত দ্রুত নতুন করোনাভাইরাস ছড়ায় তা সম্পর্কে নেচারের খবর। https://www.nature.com/articles/d41586-020-00146-w ১৪. উহানে আটকে পড়া বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতা ও মন্তব্য। https://www.nature.com/articles/d41586-020-00191-5 ১৫. কোকসের শর্তগুলি জীবাণুদ্বারা কোন রোগ ছড়ানোর প্রমাণের জন্য। https://science.umd.edu/classroom/bsci424/BSCI223WebSiteFiles/KochsPostulates.htm করোনাভাইরাস নিয়ে কিছু বিজ্ঞানীদের মন্তব্য:
১৬. করোনাভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতি, অন্য করোনাভাইরাসের সাথে মিল ও কি করা উচিত নিয়ে খুব সংক্ষেপে একটি লিখা। Another Decade, Another Coronavirus. Perlman S. N Engl J Med. 2020. (https://www.nejm.org/doi/10.1056/NEJMe2001126) ১৭. করোনাভাইরাস নিয়ে কিছু প্রশ্নের সহজ উত্তর। China coronavirus: what do we know so far? Mahase E. BMJ. 2020 (https://www.bmj.com/content/368/bmj.m308) ১৮. নোভেল করোনাভাইরাস কি কি সমস্যা করতে পারে এবং কিভাবে সমাধানের দিকে যাওয়া উচিত সেটা নিয়ে কিছুটা কঠিন লেখা। A Novel Coronavirus Emerging in China - Key Questions for Impact Assessment.Munster VJ, Koopmans M, van Doremalen N, van Riel D, de Wit E.N Engl J Med. 2020. (https://www.nejm.org/doi/10.1056/NEJMp2000929) গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: ১৯. করোনাভাইরাসের জিনোম: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/nuccore/NC_045512.2 ২০. করোনাভাইরাস নিয়ে নেচারের সহজে বুঝানো ভিডিও: https://www.youtube.com/watch?v=Q_4fIkc2k6g
বাহ! চমৎকার তথ্যবহুল এবং প্রাঞ্জল এরকম কিছুই দরকার ছিলো। ইউরোপে ইতিমধ্যে হিউম্যান-টু-হিউম্যান সংক্রমনের রিপোর্ট নিশ্চিত হয়েছে।
এই সুযোগে বলে রাখি, আপনার ভাইরোলজির সিরিজটি অনবদ্য হচ্ছে।
ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। হিউম্যান টু হিউম্যান সংক্রমণের আরেকটি খবর পেলাম ভিয়েতনামে (লিংক: https://www.nejm.org/doi/10.1056/NEJMc2001272)। এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে খুবই চিন্তার বিষয়।
শুনলাম, ২৩ ডিগ্রী তাপমাত্রায় নাকি, এই ভারাস মারা যায়? বাংলাদেশে খুব গরম, এই কারনে নাকি বাংলাদেশের ভয়ের কারন নাই, ঘটনা কি সত্য?
এটি ভুল ধারণা। সম্ভবত ডা: জাকির নামে একজন এইসব ভুল ধারণা ছড়িয়েছে। ভাইরাসের মৃত্যু বলে কোন অবস্থা নাই। ধ্বংসের কথা বলতে পারেন। বাংলাদেশসহ সকল দেশেই আক্রান্তের সম্ভাবনা রয়েছে।