জলাতঙ্ক কী?
জলাতঙ্কে কি মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়?
অন্যান্য রোগের মতোই জলাতঙ্ক নিয়ে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার রয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেন, জলাতঙ্কে কুকুর মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষণে আকর্ষিত হয়ে কামড় দেয়াতে জলাতঙ্ক হয়, তাই পেটে কুকুরের বাচ্চা হবে। সেই কুকুরের বাচ্চা ছেলে মানুষের পেটে হলে পুরুষাঙ্গ দিয়ে বের হবে। পেটে বাচ্চা হবার কারণেই নারী-পুরুষ উভয়ই মারা যায় দাবি করেন অনেকে। এই ধারণাগুলো মূলত বাংলাদেশে ও ভারতের বেশ কিছু প্রদেশে প্রচলিত। একে বলা হয় পাপি প্রেগনেন্সি সিনড্রোম (Puppy pregnancy syndrome)। এগুলোর কোনোটাই সত্যি নয়।
মূল কথা হলো, জলাতঙ্ক রোগীর পেটে কুকুরের বাচ্চা হওয়া একটা ভুল ধারণা ও কুসংস্কার।
জলাতঙ্ক রোগী মারা যায়, কারণ ভাইরাসটি প্রধান স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়ে শরীরের অনেক প্রয়োজনীয় কাজ বন্ধ করে দেয়। তাতে রোগী কোমা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শেষে মারা যায়। প্রধান স্নায়ুতন্ত্র আপনার অনেক জরুরী কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন- আপনার নিঃশ্বাস। জলাতঙ্কের ভয়ানক একটি পর্যায়ের লক্ষণ হলো নি:শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া। যেহেতু ভাইরাসটি রোগীর মস্তিষ্ককে আক্রমণ করতে সক্ষম, তাই মস্তিষ্কসহ বিভিন্ন অঙ্গে প্রদাহ, স্বাভাবিক কাজে বাধা ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে রোগী মারা যায় (এনসেফালাইটিসের মতো)।
জলাতঙ্ক রোগী পানি দেখে কি ভয় পায়?
জলাতঙ্ক কীভাবে ঘটে?
রেবিজ ভাইরাস স্নায়ুকে আক্রান্ত করতে পারে, যাকে আমরা বলি নিউরোট্রপিক ভাইরাস বা স্নায়ু-আকর্ষী ভাইরাস। ভাইরাসটি পাশ্বীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে আস্তে আস্তে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে যেতে পারে। সেখানে ভাইরাসটি একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক বা স্নায়ুর একটি জালের- যার নাম সেন্ট্রাল পেটার্ন জেনারেটর (কেন্দ্রীয় বিন্যাস তৈরিকারক), কাজে সমস্যা বাঁধায়। এই নেটওয়ার্ক শরীরের বিভিন্ন স্বাভাবিক কাজকর্ম, যেমন- হাঁটা, সাঁতার, প্রস্রাব-পায়খানা করা, চাবানো, ঢোক গেলা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। ভাইরাস এই নিউরাল নেটওয়ার্কে কাজকে ব্যাহত করে বলে জলাতঙ্ক রোগীর ঢোক গিলতে সমস্যা হয়, যে কারণে পানি পান করার সময় জলাতঙ্ক রোগীর স্প্যাজম বা খিঁচুনি বা পেশী সংকোচন হয়। তাতে রোগী পানি গেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ও আতঙ্কে ভোগে। সেই কারণে পানি দেখলে বা পানি পান করানোর চেষ্টা করলে রোগী ভয় পায় ও পান করতে চায় না। এটিকে বলা হয় জলাতঙ্ক।
নিচের ইউট্যুব ভিডিওতে দেখতে পাবেন একজন জলাতঙ্ক আক্রান্ত রোগী পানি পান করতে গেলে কেমন আচরণ করে (সতর্কতা- জলাতঙ্ক রোগীর আচরণ দেখে ভীত হতে পারেন): https://www.youtube.com/watch?v=OtiytblJzQc
সুতরাং এই ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা ব্যাহত হয়, যেমন- ঢোক গেলা। যেহেতু পানি খেতে গেলে ঢোক গিলতে হয় এবং জলাতঙ্ক রোগীর ঢোক গিলতে সমস্যা ও ব্যাথা হয়, তাই পানির প্রতি ভীতি তৈরি হয়। রেবিজ ভাইরাস উষ্ণরক্তবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী, যেমন- কুকুর, শিয়াল, বাদুড়, রেকুন, স্কাঙ্ক, বিড়াল ইত্যাদিতে সাধারণত সংক্রমিত হতে পারে। যেকোনো স্তন্যপায়ী এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হয় । তবে যেসব প্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসে এবং ইতিহাস অনুযায়ী রেবিজ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত করার ঘটনা রয়েছে, সেসব প্রেক্ষিতে উপরের প্রাণীগুলোর নাম বলা হলো। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৯০% এর বেশি জলাতঙ্কের ঘটনা ঘটে আক্রান্ত কুকুরের কামড় থেকে। এই অঞ্চলে জলাতঙ্ক নিয়ে ভুল ধারণা এবং সরকার ও জনগণের কার্যকরী পদক্ষেপের অভাবে প্রতিবছর অনেক মানুষ মারা যায়।
আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ কুকুর, বিড়াল বা বাদুড় জাতীয় কোনো প্রাণীর কামড়, আঁচড় বা ক্ষতস্থানে লালার সংস্পর্শে আসলে ডাক্তারের (পশু ও মানুষের ডাক্তারের) শরণাপন্ন হবেন।
জলাতঙ্ক ১০০% রোগমুক্ত করা যায়, যদি সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং ১০০% মরণব্যাধি, যদি দেরি করেন। সঠিক সময় হলো আপনি যখন জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে (কামড়/আঁচড়) এসেছেন ধারণা করছেন, তার এক সপ্তাহ বা তারও কম সময়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলা। একই সাথে কুকুরের আচরণ লক্ষ্য করুন। কুকুর যদি রেবিজ ভাইরাস আক্রান্ত হয়, তবে টিকা নিয়ে নেন, বা ঘটনার আগেও টিকা নিয়ে রাখতে পারেন।
জলাতঙ্ক বা হাইড্রোফোবিয়াতে রেবিজ ভাইরাসের সুবিধা কী?
এখন যেহেতু রোগী ঢোক গিলতে পারে না- তাই পানি খেতে পারে না (কুকুরের ক্ষেত্রেও পানি পানে সমস্যা দেখা দেয় অনেক সময়)। পানি পান করলে ভাইরাস লঘু বা ডাইলুট হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যে কোন ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক ভাইরাস (সংক্রমণক্ষম ভিরিয়ন) থাকলে কারো আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বাড়ে। রোগীর জলাতঙ্ক বা হাইড্রোফোবিয়া তাই ভাইরাস ছড়াতে সাহায্য করে।
সংক্ষেপে, রেবিজ ভাইরাস> কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করা> ঢোক গিলতে সমস্যা করা> ঢোক গেলার সমস্যার কারণে জলাতঙ্ক> মুখে বেশি লালার উপস্থিতি, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ঝামেলার কারণে আগ্রাসী আচরণ (কামড় দেয়া)> ভাইরাসের উপস্থিতির পরিমাণ মুখের লালাতে বেড়ে যাওয়া> ভাইরাসের ছড়ানোর সুযোগ বেড়ে যাওয়া।
রেবিজ ভাইরাসটি এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে এর সংক্রমণ ও ছড়িয়ে পড়া হোস্টের আচরণ পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে। অনুজীববিজ্ঞানে এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি ভাইরাল সংক্রমণ একটি হোস্টকে বা পোষককে সম্পূর্ণ নতুন একটি বৈশিষ্ট্য দিতে পারে, যা হোস্টের বা পোষকের বিবর্তনকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।
সহজে ভাইরাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। ভুল তথ্য বলা হলে অবশ্যই দয়া করে রেফারেন্স নিয়ে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন। পরের লেখাতে ভাইরোলজি পাঠশালা ৬.২-তে জলাতঙ্কের লক্ষণ কেন রেবিজ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াতে সাহায্য করে, সেটা ভাইরাসের বিবর্তনগত আচরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করবো। কীভাবে তা ভাইরাসের জন্য সুবিধাজনক, সেটাও বুঝতে পারবেন। ভাইরাসের গঠন বুলেটের মতো, কী কী দিয়ে তৈরি, কেন আগে পেটে অতগুলো টিকা দেয়া হতো- সেগুলো ব্যাখ্যা করবো। পরের অংশ শীঘ্রই আসবে আশা রাখছি।
3. Cat: https://www.youtube.com/watch?v=H8fbAFOMTp4