অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগে, মশা দিয়ে যদি অনেক রক্তবাহিত রোগ ছড়ায় তবে এইচআইভি ছড়ায় কি? এইডস হতে পারে? মশা কামড়ালে এইচআইভি আক্রান্তও হবে না, এইডসও হবে না। জেনে রাখা দরকার, এইচআইভি আক্রান্ত হওয়া আর এইডস এক নয়। হ্যাঁ, এইচআইভি ভাইরাস এইডস হবার কারণ। কিন্তু এইডস এইচআইভি আক্রান্ত হবার অনেক পরের ধাপ। সংক্ষেপে জানাচ্ছি –
এইচআইভি পজিটিভ রোগী
জীবনের কোন একসময় এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তা বোঝায়। এইচআইভি আক্রান্ত হবার পর কোনরকম উপসর্গ না দেয়া দিতে পারে বা সর্দি-জ্বর (ফ্ল) এর মতো উপসর্গ দেখা যায়। তাই বলে সাধারণ জ্বর-সর্দি হলেই যে এইচআইভি আক্রান্ত তা কিন্তু নয়। অধিকাংশ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে ফ্লু বা জ্বর-সর্দি উপসর্গ দেখা দেয়। (যেমন শীতকালে আমরা যে জ্বর-সর্দি আক্রান্ত হই তা প্রায় ১০০ রকম ভাইরাস দিয়ে হতে পারে।)
এইডস
এইডস হচ্ছে সেই অবস্হা যখন শরীরের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা একদম কমে যায় (এইটা জীনগত কারণ নয়) যা শরীরের বিশেষ কোষ সিডি৪+ এর সংখ্যা প্রতি মাইক্রোলিটারে ২০০ কোষ এর চেয়ে কম হয়। তাই, এইচআইভি আক্রান্ত হলেই যে এইডস হবে তা নয়। এইডস এইচআইভি আক্রান্তের শেষ ধাপ। সহজ ভাষায়, এইচআইভি আক্রান্ত হলে আপনি সারাজীবন তা বহন করবেন কিন্তু আপনার এইডস হবে কিনা তা নির্ভর করে আপনার চিকিৎসা, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা, ভাইরাসের স্ট্রেইন ইত্যাদির উপর। বর্তমানে, শক্তিশালী এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি(সিএআরটি/হার্ট) দ্বারা অনেক এইচআইভি রোগী স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করে মৃত্যুবরণ করে (তার মানে এই নয় যে তাদের শরীর থেকে ভাইরাস চলে গেছে বা তারা সম্পূর্ণ এইচআইভিমুক্ত)।
এখন আসি, মশা দিয়ে কি এইচআইভি ছড়াবে কিনা? উত্তর হচ্ছে, না।
মশা দিয়ে এইচআইভি ছড়ায় না। কারণগুলো নিচে ব্যাখ্যা করছি।
১. মশা আর সূচ/সিরিঞ্জ এক নয়:
একই সূঁচ/সিরিঞ্জ ব্যবহারে এইচআইভির সম্ভাবনা বেশি থাকে। সম্ভাবনা বেশি থাকে যখন এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি দ্বারা ব্যবহৃত সূঁচ আরেকজন অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবহার করে। এজন্য, যারা নেশাদ্রব্যসেবনকারী (মাদকসেবী) তাদের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি (সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হেপাটাইটিস ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার)। এখন, সূচ/সিরিঞ্জ আর মশা কেন এক নয় নিচে কিছু পয়েন্টে ব্যাখ্যা করছি।
ক. রক্তের পরিমাণ:
সূচ/সিরিঞ্জ বাইরের পরিবেশ থেকে রক্তকে আলাদা রাখে বেশ খানিকক্ষণ সময়(কত সময় সেটা জানি না!)। এখন, যারা মাদকসেবী তারা খুব দ্রুতই একই সিরিঞ্জ একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার করে। সূঁচ ও সিরিঞ্জে থেকে যাওয়া রক্তের পরিমাণ মশার দেহে থাকা রক্তের চেয়ে বেশি। তাতে সম্ভাবনা বেড়ে যায় এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ার। অন্য দিকে একটি মশা যখন একজন মানুষের কাছ থেকে রক্ত খায়, সে খুবই অল্প পরিমাণ রক্ত নিতে পারে। একজন এইচআইভি আক্রান্ত মানুষের রক্তে এইচআইভি এর সংখ্যা (কপি) প্রায় প্রতি মিলিলিটারে ১ মিলিয়ন কপি(যখন এইচআইভি সম্পূর্ণভাবে সক্রিয়) থেকে ৪০-৭৫ কপি হতে পারে। এখন, একটি মশা (স্ত্রী মশা) একবার কামড়ে সর্বোচ্চ ১ লিটারের ত্রিশ লাখ ভাগের একভাগ বা পঞ্চাশ লাখ ভাগের একভাগ রক্ত পান করে (লিংক: ১ ও ২) । সুতরা এক মিলিলিটারের ৩০০০ ভাগের একভাগ বা ৫০০০ ভাগের একভাগ রক্ত বহন করে। ধরে নিলাম, যাকে মশা কামড় দিচ্ছে তার রক্তের প্রতি মিলিলিটারে ১ মিলিয়ন কপি ভাইরাস বহন করছে। তাহলে, ঐ মশা যদি ঐ ব্যক্তিকে কামড় দিবে তখন সর্বোচ্চ প্রায় ৩৩৩ কপি বা ২০০ কপি ভাইরাস নিতে পারে। এখানে কথা হচ্ছে, মশা সাধারণত পেরিফেরাল রক্ত খেয়ে থাকে। শরীরের ঐসব স্হানের রক্তে(এমনকি অন্যান্য বহু জায়গায়) এত বেশি (১ মিলিয়ন/মিলিলিটার) ভাইরাস থাকে না।
তবুও ধরে নিলাম, ঐ ব্যক্তির শরীরে রয়েছে। এখন, মশাতে এইচআইভি সংখ্যাবৃদ্ধি সহায়ক বা এমন কিছু নেই যা এইচআইভিকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য (সত্যিকারার্থে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়)। তাছাড়া, মানুষের দেহের বাইরে এইচআইভি ধ্বংস হয়ে যায় (যদি না ল্যাবে বিশেষ তাপমাত্রা (-৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং বিশেষ কেমিক্যাল দেয়া তরলে(মিডিয়া) রাখা হয়।) সুতরাং, ঐ মশায় অধিকাংশ ভাইরাস সক্রিয় থাকবে না। তারপরও, ধরে নিলাম, প্রায় একশ এইচআইভি ঐ মশায় সক্রিয় থাকলো। তারপরেও, ঐ মশা পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাইরাস বহন করে না এইচআইভি ছড়িয়ে দেবার জন্য। কমপক্ষে, এ মশাতে ২০০ কপি বা তার বেশি ভাইরাস দরকার।
খ. রক্ত পরিবহনের সময়
তারপরও, ধরা হলো, মশায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাইরাস রয়েছে। এখন, একটি মশা রক্ত খাবার পর সাধারণত কয়েকঘন্টা বিশ্রাম নেয়। এইভাবে এইচআইভি সংক্রমণ করতে হলে, মশাকে দ্রুত আরেকজনকে কামড়াতে হবে তা আর হচ্ছে না। আর যদি কামড়ও দেয় তাহলেও ছড়াবে না। কারণটা নিচে বলছি।
গ. মশা মানুষের শরীরে নিজের লালা ছড়ায়, রক্ত নয়।
মশা যখন কোন মানুষকে কামড় দেয়, তখন সে মানুষে অন্য মানুষের রক্ত ছড়ায় না, বরং নিজের লালা ছড়ায়।যেসব ভাইরাস মশা দিয়ে ছড়ায় সেগুলো মশার লালা দিয়ে ছড়ায়। এখন, খালি চোখে দেখলে মশার হুলকে (মুখপাঙ্গ) একটা মনে হয় (চিত্র ১)। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন।
চিত্র ৩: মশার ছয়টি সূঁচ। সবুজ সূঁচ দিয়ে মশা তার লালা ছড়ায় এবং লাল সূঁচ দিয়ে রক্ত। বাকি সূঁচ চামড়া টেনে রেখে রক্ত খেতে সাহায্য করে। রঙ দেয়া হয়েছে বোঝানোর সুবিধার জন্য।
এই ইউট্যুভ লিংকে (একদম ভিডিওসহ ফ্রান্স!) সহজে বুঝতে পারবেন কিভাবে মশা রক্ত খায় (লিংক: ৩ )। যদি পড়তে চান তবে এই লিংক পড়ুন (লিংক: ৪ )
২. মশার পেটে এইচআইভি ধ্বংস হয়ে যায়
এইচআইভি মানুষের সিডি৪+ টি সেল ছাড়া বাঁচতে পারে না। যখন মশা এইচআইভিযুক্ত রক্ত খায়, সেটা মশার পেটে যায়। মশার পেটে থাকা এসিড এইচআইভিকে ধ্বংস করে। কারণ, এইচআইভি এনভেলপড ভাইরাস যা পিএইচ (অম্ল-ক্ষারত্ব পরিমাপক), তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার প্রতি সংবেদী। আর মশার পেটে এইচআইভি এর কোনো বংশবৃদ্ধি হয় না। যদি কোনো ভাইরাস মশার দেহে বংশবৃদ্ধি না করতে পারে, তবে তা মশার মাধ্যমে ছড়াতে পারে না। সাধারণত, যেসব ভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়ায় তারা রক্তের মাধ্যমে দেহে আসে, তারপর মশার দেহে বংশবৃদ্ধি করে, বংশবৃদ্ধিতে মশা অনেকসময় নিজেও আক্রান্ত হতে পারে (সব ভাইরাসের ক্ষেত্রে), পরবর্তীতে মশার লালায় ভাইরাস স্হানান্তরিত হয়। তাই যখন মশার কামড় দেয়, তখন মশা কর্তৃক নি:সৃত লালা ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় (চিত্র ৪)। যেহেতু এইচআইভি মশার পেটে ধ্বংস হয়ে যায় এবং কোনো বংশবৃদ্ধি করতে পারে না, তাই মশার দিয়ে এইচআইভি ছড়াতে পারে না।
৩. এইচআইভি হচ্ছে রেট্রোভাইরাস শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত:
এইচআইভি হচ্ছে রেট্রোভাইরাস শ্রেণীর অন্তভূক্ত। অন্যদিকে মশার বা কীটপতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ানো ভাইরাসদের আর্বোভাইরাস বলা হয় (আর্বোভাইরাস নামের ব্যান্ড সঙ্গীতের দলের নাম বলছি না)। আর্বোভাইরাস শ্রেণীর ভাইরাসরা দুটি পোষকে (হোস্ট; যেমন মানুষ) বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এদের বংশবৃদ্ধি প্রকৃতি এবং ভাইরাসের জীনোমের বিন্যাস রেট্রোভাইরাস শ্রেণী থেকে ভিন্ন। তাছাড়া বিবর্তনে আর্বোভাইরাসরা কীট এবং পোষকের দেহে নিজেদেরকে মানিয়ে নেয়ার সকল উপায় বেছে নিয়েছে। অপর দিকে এইচআইভি শুধু মাত্র মানুষ নিজেকে মানিয়ে নিবার জন্য বিবর্তিত করেছে।
৪. মশা প্রধানত রক্তের লোহিত রক্তকণিকা খায়
মূলত এটাই প্রধান যুক্তি হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সাধারণ ভাবে বোঝানোর জন্য অন্য যুক্তিগুলো নিয়ে আসা। মশা প্রধানত লোহিত রক্ত কণিকার জন্য রক্ত খায়। লোহিত রক্ত কণিকায় প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। অন্যদিকে এইচআইভি রক্তের শ্বেত রক্ত কণিকার পাঁচ প্রকারের মধ্যে একপ্রকার লিম্ফোসাইটের দুই শাখার (বি লিম্ফোসাইট আর টি লিম্ফোসাইট) একটি (টি লিম্ফোসাইটের) দুই প্রধান শাখার (সিডি৮+ এবং সিডি৪+) একটিকে আক্রমণ করে (সিডি৪+ টি সেল)। (আরো অনেক শাখা বলিনি, বিশেষ করে টি সেলের আরো ছয় ধরনের সেল রয়েছে। বিস্তারিত পড়তে উইকিলিংক: ৫)। প্রতি মাইক্রোলিটার (এক লিটারের ১০০০ ভাগের এক ভাগ) রক্তে প্রায় ৪,৫০০ থেকে ১০,০০০ শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে ( লিংক: ৬)। সুস্হ মানুষের রক্তে প্রতি মাইক্রোলিটারে ৪৫০-১৬৯০ সংখ্যক সিডি৪+ থাকে (লিংক: ৭)। এখন যখন এইডস হয়, তখন এই সংখ্যা ২০০ এর নিচে চলে যায়। তাই মশার পেটে কত কম সংখ্যক সিডি৪+ টিসেল আছে বুঝতেই পারছেন। মোদ্দাকথা, মশা যদি রক্ত খেয়েও থাকে সেখানে সর্বোচ্চ পরিমাণ এইচআইভির পরিমাণ (১ নম্বর পয়েন্টের হিসাব এখন আরো কমে যাবে) আক্রান্ত করার সমকক্ষ হবে না। নেচারের এক ব্লগে এক গ্রাড স্টুডেন্ট এর মতে ১০০ লক্ষ মশা একবারে কামড় দিতে হবে যেখানে সব মশার এইচআইভি আক্রান্ত রক্ত সম্পন্ন হতে হবে। তারপরও যে এইচআইভি আক্রান্ত হবে তার গ্যারান্টি নাই। (লিংক: ৮)
মশা এইচআইভি এর বাহক নয়। যেমন মশা হেপাটাইটিস বি/সি এরও বাহক। এই তিনটি ভাইরাসই রক্তবাহিত ভাইরাসজনিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে উপরের দিকে রয়েছে। মশা অনেক রোগ ছড়ায়। কিছু ভাইরাস দিয়ে যেমন ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনইয়া, ওয়েস্টনাইল ইত্যাদি ভাইরাস। কিছু পরজীবী(প্রোটোজোয়া ও কৃমি) দিয়ে ছড়ায় যেমন ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া (গোদ রোগ) ইত্যাদি।
বাংলাদেশে আবহাওয়া মশার প্রজনন ও বিস্তারের জন্য সহায়ক। কোথাও পানি জমে থাকলে মশা সেখানে ডিম পাড়ে। জমে থাকা পানি ফেলে দিন বা কেরোসিন ঢেলে দিন। টব, পুরনো টায়ার, ফেলে দেয়া বোতল, প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ইত্যাদিতে মশা বংশবৃদ্ধি করে।
সবশেষে, সংক্ষেপে মশা এইচআইভি ছড়ায় না। কারণ, মশার দেহে এইচআইভি বাঁচে না, বংশবৃদ্ধি করে না এবং মশার দ্বারা এইচআইভি ছড়ানোর উপায় নাই। আসুন, নিজে জানি অন্যকে জানাই।
[কোনো বিজ্ঞানজার্নালের লিংক দেয়া হলো না। তবে যারা আগ্রহী তারা পাবমেডে এইচআইভি এর রিভিউগুলো পড়তে পারেন।]
পুনশ্চ:
১. সহজভাবে বোঝানোর জন্য সহজ ভাষায় লিখার চেষ্টা করেছি। অনেক সায়েন্টিফিক টার্ম বাদ দিয়েছি। যথাসম্ভব বাংলায় লিখার চেষ্টা করেছি।
২. আরো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে করতে পারেন বা মেসেজ জানাতে পারেন। জানার জন্য কোন লজ্জা বা ভয় থাকা উচিত না।
৩. বড় পোস্টের জন্য দু:খিত।
৪. ভুল-ত্রুটি কমেন্টে উল্লেখ করলে খুবই খুশি হবো।
৫. ব্যকরণগত ত্রুটি এবং ভুল শব্দের প্রয়োগ থাকতে পারে।
I am a postdoctoral researcher (Buck Institute, CA, USA) and did my Ph.D on Molecular Virology (SARS-CoV2 and ZIKV). Previously, background: Genetic Engineering & Biotechnology(BS & MS, DU, Bangladesh); Infection & Immunity (MSc, EUR, Netherlands). I have done research on molecular virology (HIV, Zika, HCV & HBV). My focuses are understanding host-viral interaction, viral evolution and disease modeling. Current research focuses are T-cell metabolism in HIV, and Immune Aging.