ময়লা, ভালোবাসা আর কর্তব্য

একটা ছোট্ট বাচ্চা, যে এখনো স্কুলেও ভর্তি হয়নি, সে সারাটা দিন কী কী করতে পারে? খেলা? লাফালাফি? বাঁদরামি? মারামারি? কার্টুন দেখা? আর কিছু আসছে মাথায়? ভাবছেন, আর কীই বা করতে পারে…

যদি বলি, তার সারাটা সকাল আর দুপুর যায় ময়লা দেখতে দেখতে? না, ছেলেটা টোকাই না। সে ময়লা ঘাঁটে না, শুধু তাকিয়েই থাকে। অবাক করার বিষয় হলো, ছেলেটা কেন যেন ময়লা-আবর্জনা দেখতে ভালবাসে। আসলে শুধু ময়লা না, মেথর চাচারা কী সুনিপুণ হাতে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে, সে সেটাও দেখে তন্ময় হয়ে। দুপুরের রোদ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, ছেলেটার গায়ের রঙ কালো থেকে আরো কালো হয়। সে খেলে ঠিকই, তবে বিকেলে। সকাল আর দুপুরে তাকে আকৃষ্ট করে এই ময়লাগুলো। প্রতিদিন এই সময়েই সুইপার আঙ্কেলরা আসেন। কলোনির নালাগুলো খুব সুন্দর ভাবে তৈরি করা, সব নালা এসে প্রধান মুখে মিলে। মেথর চাচারা প্রতিদিন নালার ময়লাগুলোকে টেনে টেনে আনেন। তাদের হাতে থাকে লোহার তৈরি এক হাতিয়ার, মাথায় বিরাট বিরাট দাঁত। ঐ দাঁতেই আটকে যায় সব। কোনো ঘরের স্ল্যাব পথে পড়লে, কী অপার দক্ষতায়ই সেটাকে অপর পাশে নিয়ে যান! তারপর সব ময়লাগুলোকে এক করে কীভাবে যেন ড্রামে তুলে ফেলেন! এটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি ছেলেটা। সব ময়লা চলে যায়। কেমন যেন একা হয়ে পড়ে নালাগুলো। একা আর বিষণ্ণ! বয়ে চলা পানির পথ আর কোনো ময়লা আটকে দেয় না। ছেলেটার অবশ্য সেটাও ভাল লাগে। অদ্ভুত অবস্থা, আবর্জনায় আটকে থাকা নালা সে যেভাবে নিষ্পলক তাকিয়ে দেখে, আবর্জনামুক্ত পানির স্রোত বয়ে চলা নালাও সে দেখে একই রকম অপলক হয়ে।

01. Science

মেথর চাচারা ঠিক বুঝতে পারেন না, ছেলেটা কী চায়। তাই ময়লা পরিষ্কারের এই সময়টাতে ছেলেটার সাথে গল্প জুড়ে দেন। গল্প ছাড়া কী আর বলা যায় এত পিচ্চি ছেলেকে! ছেলেটা তখন শুধু ময়লা পরিষ্কার করা দেখতেই আসে না, গল্প শুনতেও আসে। কোনো একদিন না আসলে, মেথর চাচারাও যেন একটু চিন্তায়ই পড়ে যান। ব্যপ্তিটা বেশি হলে, ছেলেটার বাসার নালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, একবার তার বাসায় ঢুঁ মেরে যান।

প্রতিদিনের নালা যেমন পরিষ্কার হয়, তেমনি কয়েকদিন পরপর বাসায় এসে কমোডগুলোও পরিষ্কার করা হয়। হারপিক না, নাইজল বা এই টাইপের একটা নাম। ছিটিয়ে দিয়ে তাদের একটু ঘষাতেই চকচকে সাদা হয়ে ওঠে হলদেটে কমোড। কয়েকদিন পর পর ব্লিচিং পাউডারও দিয়ে যান। ওটা দিয়ে বাথরুম (গোসলখানা) গুলো পরিষ্কার করা হয়, বিশেষ করে পিচ্ছিল ভাবটা দূর করা হয়।

ছেলেটার কেন যেন টয়লেট পরিষ্কার করা এই লিকুইডের গন্ধ বড্ড ভাল লাগে। কয়েকজনকে বলায় তারা হাসাহাসি করে। তাই এরপর থেকে সে আর কাউকে বলে না। বাসায় শুধু না, এই লিকুইড তার স্কুলের টয়লেটেও দেয়া হয়। তার টয়লেটে খুব একটা যেতে হয় না। কিন্তু যখন টয়লেট পরিষ্কার হয়, তখন এই লিকুইডের গন্ধ নেয়ার জন্য হলেও সে যায়। আজিব গন্ধানুভূতি!

ছেলেটা যখন গ্রামে তার নানাবাড়িতে যায়, তখন সেই অর্থে কিছুই পায় না। নালা নেই, ভালো বাথরুম বা টয়লেট নেই। যাও আছে, তা উন্মুক্ত টয়লেট [না টয়লেটের জায়গাটা চারিদিকে উন্মুক্ত না, টয়লেটের দ্রব্যাদি যেখানে যায় বা যেখানে জমা হয় সেটা উন্মুক্ত]। তবে পুকুর আর পাহাড় আছে, বস্তা আইসক্রিম আছে, এতেই তার চলে যায়। তবে একবার ছেলেটা ঠিকই সেই উন্মুক্ত টয়লেটে বসে, দিগন্তের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, হঠাৎ একটা জিনিস খুঁজে পায়। ছোট্ট, সাদা একধরনের অন্যরকম পোকা। অনেকটা রেশম মথের মত, তবে অনেক অনেক ছোটো। কথ্য ভাষায় “ল্যাদাপোক” (!), এই ধরনের পোকা কখনো তার চোখে পড়েনি, সে একছুটে যায় তার মামাতো ভাই বোনের কাছে। তারা এখানে থাকে, তারাই তো চিনবে। কোথায় তারা এটা দেখে তাকে চেনাতে আসবে, উলটো ঝাড়ি মারা শুরু করলো। বেচারা বুঝলো, এই কম্মো এখানে হওয়ার নয়।

ছেলেটা একটু একটু বড় হয়। আবর্জনা বা ডাস্টবিন বা নালা এদের প্রতি তার আকর্ষণ কিন্তু কমে না। সে খেয়াল করে, কাক তার প্রিয় পাখি। কীভাবে প্রিয় সেটা সে জানে না, কিন্তু এখন যে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে অনেক সুন্দর যুক্তি দেখিয়ে দেয়। কে জানে, হয়তো এই ডাস্টবিন দেখতেই দেখতেই, কাক হয়ে উঠেছে তার প্রিয় পাখি, আর কুকুর তার প্রিয় পশু।

রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সে তাকিয়ে থাকে, উপচে পড়া ডাস্টবিনগুলোর দিকে। ময়লা পরিষ্কারে ব্যস্ত সিটি কর্পোরেশনের মানুষদের দেখে শ্রদ্ধায় তার মাথা নুয়ে আসে। সে তাদের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারে না। তীব্র গন্ধ ঠেকানোর মাস্ক বা হাতে ময়লা না লাগার গ্লাভস তো দূরের কথা, এমনকি তাদের অনেকের পায়ে একজোড়া স্যান্ডেলও নেই। আর এসবের ভেতরেও তারা কাজ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন! ময়লা বহনকারী গাড়িগুলোর চরম বেহাল দশা। প্রায়ই গাড়ি থেকে ময়লা উড়ে যায় বাতাসে, কখনো আবার বেরিয়ে আসে নিচ থেকে। এমন ময়লা বহনকারী গাড়ি মনে হয় বিশ্বের কোথাও নেই। আর এসব দেখারও যেন কেউ নেই। পরিবেশ নিয়ে বড্ড কাজ করতে ইচ্ছে করে তার……

ছেলেটা বড় হতে হতে, একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর কী অবাক ব্যাপার, সে কোথাও টিকলো না! এমনকি ওয়েটিং লিস্টেও কোথাও নেই সে! কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে চবির পরিবেশ বিজ্ঞানে একেবারে ২১ নাম্বার মেধা তালিকায়। সে ভেবে দেখে, এটাই তো হওয়ার কথা। পরিবেশ নিয়েই তো তার কাজ করার কথা। [যদিও ভর্তি পরীক্ষায় পরিবেশ নিয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দিয়েছিলো কিনা, তা ওর মনে পড়ে না 😛 ]

কিন্তু হায়! এ কী অবস্থা! বিশ্ববিদ্যালয় তার পরিবেশ নিয়ে কাজ করার পেছনে কোথায় জ্বালানি যোগাবে তা না, উলটো দেখা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তাকে বিরক্ত থেকে বিরক্ততর করে তুলছে। যতটুকু আগ্রহ তার ছিল বিজ্ঞান আর পরিবেশ নিয়ে কাজ করার তার প্রায় সবটুকুই উবে যেতে বসেছে। নীরব সময়গুলোতে সে নিজেকেই দোষ দিতে লাগলো, হয়তো এটা তারই ব্যর্থতা, নিজেকে এসবের সাথে সে মানিয়ে নিতে পারছে না। আস্তে আস্তে নিজেকে সে গুটিয়ে নিতে থাকলো আর ভাবতে থাকলো কী করা যায়, কীভাবে সে তার আগ্রহ, তার কৌতূহল, তার গবেষণা বা কাজের ইচ্ছেকে টিকিয়ে রাখবে। আর শুধু ইচ্ছে টিকিয়ে রাখলে তো হবে না, সেটাকে বাস্তব রূপও দিতে হবে। কীভাবে করবে সে এতসব?

উপায় একটা পেয়ে গেল সে, অদ্ভুত!

নিজের লক্ষ্য ঠিক করে নিলো নতুনভাবে। তার এতটাই আত্মবিশ্বাস যে সে জানে, চাইলেই সে অনেক অনেক ভাল রেজাল্ট করতে পারে, চাইলেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হতে পারে, কিন্তু না, সেটা সে করবে না। সেটা করতে গেলে ততদিনে তার ভেতরটা তেতো হয়ে যাবে পুরোপুরি। আর তেতো জীবন নিয়ে তোতা পাখির মত বুলি আওড়ে যেতে হবে জীবনের শেষ পর্যন্ত। সেটা সম্ভব না। তাই কোন রকমে সেই ল্যাঠা চুকাবে সে। শিক্ষক না হয়ে সে সরাসরি গবেষক হতে পারে। কিন্তু না, সে পথেও আছে কাঁটা। নিজের গবেষণার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য একজন গবেষককে যে কত জায়গায় কত জনের কাছে হাত পাততে হয়, তা তার জানা হয়ে গেছে বহু আগেই। সে গবেষণা নিয়ে ভাববে, না হাত পাতা নিয়ে ভাববে, তাই সে বাদ দিলো সে পথও। ছেলেটার অনেক শিক্ষক বলতেন সে রাজনীতিবিদ হতে পারে, কারো মতে উকিল, কারো মতে উঁচু চাকুরে। কিন্তু না কিছুই হতে চাইলো না সে শেষ পর্যন্ত। জন্মের পর থেকেই চরম একগুঁয়েভাবে নিজের রাস্তা নিজে বেছে নেয়ার মনোভাব তাকে অন্য ইশারাই দিচ্ছিলো।

ছেলেটা ঠিক করলো, সে ব্যবসা করবে। পরিচিত মানুষেরা হতবাক, পাথর-প্রায়। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরবে না। অনেক কিছু ভেবেই যে এই সিদ্ধান্ত নেয়া। শুনতে অন্যরকম শোনালেও, একজন বিজ্ঞানী যা আবিষ্কার করেন সেই আবিষ্কারের সার্থকতা প্রমাণ করা একজন ব্যবসায়ীর ঘাড়েই বর্তায়। তার সফল বাজারজাতের উপর নির্ভর করে সেই আবিষ্কারের ফল মানুষ পাবে কিনা। সোলার প্যানেল আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী, কিন্তু তা কম মূল্যে কীভাবে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে ভাবেন একজন ব্যবসায়ী। মানুষের হাতের নাগালে না আসা পর্যন্ত বা ব্যবহার বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত সেই আবিষ্কার সভ্যতার কাজে আসতে পারে কি? শুধু তা-ই না, একজন ব্যবসায়ীর তার পছন্দের গবেষণার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হয় না। সে নিজেই নিজের গবেষণার পৃষ্ঠপোষক। ঠিক এতটুকু ভাবনাই ছিলো ছেলেটার নিউরনে, যখন সে শুরু করছিলো।

এখনো তিন বছরও পেরোয়নি। সে জানতো, সে আগাবে। সে জানতো, সে কাজ করতে চাইলে কেউ বা কোনকিছুই তাকে আটকাতে পারবে না। কিন্তু এই অল্প সময়ের ভেতরে এতসব অভিজ্ঞতা ছেলেটার সুদূরতম চিন্তারও বাইরে ছিলো। একজন ব্যবসায়ীকে কতকিছুই না জানতে হয়, কত ধোঁকাই না খেতে হয়, কত মানুষের সাথেই না মিশতে হয়, কখনো চরম কঠোর আবার কখনো চরম নরম হতে হয়। কত ঝড়, কত অপমান, কত হতাশা। এত কিছুর পরেও সবার সামনে মুখের হাসি ধরে রাখা। আবার এইসব পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত বড় বড় নামের সাথে হাত মেলানো। এগিয়ে যাওয়া। দুচোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে সে দেখে ফেলে আসা সময়গুলোকে। একজন ব্যবসায়ী হতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা তার হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা অন্য কোন ভাবেই তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব ছিল না। মানুষ চেনা, বাস্তবতাকে চেনা, বাজারকে চেনা, চোরাবালিগুলোকে চেনা, মরীচিকাকে চেনা, আরো কত কী! সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা ছেলেটাকে আলোড়িত করে সেটা হলো, পরিচিতি। একেবারে উঁচু থেকে একেবারে নিচু পর্যায়ের সকল মানুষের কাছ থেকে পাওয়া আস্থা, পাওয়া পরিচিতির সাথে তুলনীয় আর কিছুই হতে পারে না, অন্তত একজন সত্যিকার ব্যবসায়ীর কাছে। এবং সে নিশ্চিত, এইসব অভিজ্ঞতাই তাকে তার কাজের চূড়ান্ত সফলতা এনে দেবে।

প্রশ্ন আসতে পারে, আবর্জনার দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা কই? সে কি হারিয়ে গেলো টাকার ধান্ধায়? না, সে আছে। এখন পর্যন্ত সে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয়নি। কাজের সময় নিউরনের হিডেন ফোল্ডারে রাখা ফাইলগুলোকে অবসর সময়ে বাইরে বের করে নিয়ে এসে, প্রায় রাতেই সে নাড়াচাড়া করে, নিজের সাথে নিজের জবাবদিহিতা চালায়। তার একেকটি প্ল্যান, কোনটার পর কোনটা বাস্তবায়ন করবে, কীভাবে করবে, সেই সব প্ল্যানের কোথায় কোনো ত্রুটি রয়ে গেল কিনা সেসব নিয়ে ভাবাই যেন তার অবসর।

কিছুদিন আগে ছেলেটার সন্ধান পায় একটা উদ্যমী ছেলের, নাম – বোয়ান স্ল্যাট। সেকেন্ডারি স্কুলে থাকতেই যে মহাসমুদ্রের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিকগুলো কীভাবে পরিষ্কার করা যায় সেটা নিয়ে গবেষণায় লেগেছিলো। দুই বছর আগে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে সে তার এই কনসেপ্ট শেয়ার করে বিশ্বের কাছে। অনেক আলোচনা, সমালোচনার শিকার হয় তার এই গবেষণা। শেষ পর্যন্ত নিজেকে প্রমাণ করার গোঁ ধরে বসে সে। অ্যারো স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ালেখায় ১ম বছরেই বিরতি দেয়। শেষ পর্যন্ত এই গেল ৩ জুন, ২ বছর পর বাস্তবিক অর্থেই নিজেকে প্রমাণ করতে পারে। প্রকাশিত হয় ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট।

Boyan Slat, dutch environmentalist

Boyan Slat, dutch environmentalist

১৯ বছর বয়সী বোয়ানের সাথে এখন আছে নানা বিষয়ে সেরা ও অভিজ্ঞ ১০০ জন মানুষ। বোয়ানের এই জয় ছেলেটাকে আরো উজ্জীবিত করে। ছেলেটার আত্মবিশ্বাসকে আর দৃঢ় করে যে, নাছোড়বান্দা টাইপ ইচ্ছে থাকলে যেকোন কিছুই করা সম্ভব। যেকোন কিছুই! ছেলেটা নিজেও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বোয়ানের দলের একজন হিসেবে কাজ করার জন্য http://www.theoceancleanup.com/ সাইটে নক দেয়। কে জানে, তার সেই সৌভাগ্য হবে কিনা!

হ্যাঁ, সেই আবর্জনা-প্রেমী ছেলেটা আর কেউ না, আমিই। বোয়ান তার কাজের জন্য ক্রাউডফান্ডিং-এর ডাক দিয়েছে। ২ মিলিয়ন ডলার চাই তার এই কাজে। এখন পর্যন্ত এসেছে ৮ লাখেরও বেশী। বোয়ানের নেদারল্যান্ডে এমন কাজে হাত বাড়িয়ে দেয় অনেকেই। বাংলাদেশে এটা আশা করাও বোকামি। আমি অবশ্য আশা করিওনি কখনো। বোয়ানকে আমি ছোট করছি না। বরং এই ক্রাউডফান্ডের জবাবদিহিতার বিশাল চাপ মাথায় নিয়েই তাকে কাজ করতে হবে। আমার আসলে এত চাপ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে নেই। আমি যা করার নিজের মত করবো। যা জবাবদিহি তা নিজের কাছেই করবো। তবে কাকতালীয়ভাবে ওর সাথে আমার প্রথম কাজ মিলে যাচ্ছে। হাজারো প্ল্যানের মাঝে আমারও প্রথম কাজ, আবর্জনা-মুক্ত করা, তবে সমুদ্র না, আগে স্থল। প্রতিটা এলাকা ধরে ধরে আবর্জনা-মুক্ত করার সহজ, সাধারণ পদ্ধতি নিয়েই আমি আসবো। এদেশে শুধু ফিজিবলিটি স্টাডি রিপোর্টে নিজেকে প্রমাণ করলেই চলে না, আরো অনেক জায়গায় অনেক ভাবে অনেক কিছু ম্যানেজ করে কাজে নামতে হয়। সেই সব ব্যাপারেও সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আমি মাঠে নামবো। আর্থিক প্রস্তুতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, কাজের জন্য সঠিক মানুষ পাওয়াও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। কে কী ভাববে আমি জানিনা, তবে আমার কেন যেন মনে হয় এই ফেসবুকেই আমি আমার মনের মত মানুষগুলো খুঁজে পাবো। অফলাইনেও পাচ্ছি ক’জন। নীরবেই কাজ করছি, চিন্তা করছি, মানুষ খুঁজছি। যখন একসময় নিজের অর্থেই বিজ্ঞান আর পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করবো বলে প্ল্যান করেছিলাম, তখন নিজেকে টার্গেট দিয়েছিলাম ২০২০। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তার অনেক আগেই শুরু করতে পারবো।

প্রতিটা এলাকা নির্দিষ্ট আয়তন এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের উপর ভাগ করা হবে। ধরে নিলাম, প্রতিটা ভাগ হবে একেকটি জোন। প্রতিটা জোনের আওতায় থাকা মানুষের বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহে থাকবে একটা দল। তারা নিজেরা গিয়ে আবর্জনা নিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে কোন অর্থই দিতে হবে না সেই বাড়ির মানুষদের। বরং যে বাড়ি থেকে প্রতি সপ্তাহে বা মাসে সবচেয়ে বেশী আবর্জনা সংগ্রহ হবে সেই বাড়ির জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থা রাখা হবে। পুরষ্কারের নাম হতে পারে “সপ্তাহের পরিচ্ছন্নতম বাড়ি”। এইসব আবর্জনা নিয়ে কী করা হবে সেটাই হল বিষয়। জৈব-আবর্জনা বায়োগ্যাসে ব্যবহার করা হবে, মাছের বা মুরগীর খাদ্য তৈরিতে কাজে লাগবে। প্লাস্টিক গলিয়ে পরিশোধন করে আবার প্লাস্টিক হবে। তবে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেই নজর থাকবে বেশী। যেটা রিসাইকেল করা সম্ভব না, সেটা কী করা যায় তা এখনো ভেবে উঠতে পারিনি। এসব নিয়ে ভাবার জন্য আমার বিশেষজ্ঞ প্যানেল তো থাকবেনই। আরেকটা অন্যরকম কাজ করবো। প্রতিটা জোনে থাকা বাড়িগুলোর সুয়ারেজ লাইন সব একজায়গায় এসে মেলাবো। প্রতিটা মানুষের শরীরের বর্জ্য এসে মিশবে সেখানে। বায়োগ্যাসের জন্য এর চেয়ে ভাল উপাদান আর কী হতে পারে। যে বাড়ি থেকে বেশী বর্জ্য আসবে তাদের জন্য পুরষ্কার রাখা যায়? 😛 নাহ! সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে… 😉

সব আবর্জনা তো আর বাসায় হয় না। রাস্তায় মানুষের ফেলে দেয়া প্যাকেট সহ অন্য সব আবর্জনা কুড়িয়ে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলার স্বেচ্ছাসেবক থাকবে। ডাস্টবিন গুলোতে লুকানো ক্যামেরায় ধরা পড়া এমন মানুষদের থেকে প্রতি সপ্তাহে একজনকে সেরা হিসেবে বেছে নেয়া হবে। থাকবে বিশেষ সম্মাননা। একই সাথে অযথা নোংরা করা মানুষগুলোর ভিডিও নেয়া হবে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে সবার কাছে ক্ষমা চাইতে আর পরবর্তীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে উৎসাহ দেয়া হবে। মানুষের বাড়ি থেকে আবর্জনা নেয়া গাড়িগুলোই, একই সাথে ডাস্টবিনগুলো থেকেও আবর্জনা সংগ্রহ করবে। আবর্জনা সংগ্রহ করা মানুষগুলোকে খালি পায়ে ছেড়ে দেয়া হবে না। তাদের পায়ে বিশেষ বুট তো থাকবেই, হাতে থাকবে গ্লাভস, গায়ে বিশেষ পোশাক, প্রয়োজনে মুখে মাস্ক। আর গাড়িতে রাখা নানারকম আবর্জনা যাতে কোথাও বিন্দুমাত্রও পড়ে যাওয়ার সুযোগ না পায়, সে ব্যবস্থাও করা হবে।

এই আবর্জনা আর মানব বর্জ্য রিসাইকেল করে পাওয়া অর্থ দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আবর্জনা আনা মানুষের বেতন হয়ে যাবে। আর এই পুরো প্রকল্প চালানোর অর্থও উঠে আসবে। এভাবে প্রতিটা জোন হয়ে উঠবে স্বাবলম্বী। আর বাঙালির স্বভাব তো আমরা জানি, ফ্রি দিলে এমনেই ময়লা হাতে ধরায়া দিবে, আর পুরষ্কার আছে শুনলে আলসেমি করে যেগুলো ফেলবে সেগুলোও জমিয়ে রাখবে।

একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর এলাকার জন্য এর চেয়ে বেশী আর কী চাই……… এই পদ্ধতি দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়বে দেশান্তরে। জানি, শুনতে রূপকথার মত শোনালেও এটাও বাস্তব হবে একদিন। আগের অনেক রূপকথাই যে আজ আর রূপকথা নেই। আহ! কী অসাধারণই না হবে এই পৃথিবীটা সেদিন। দুচোখ বোজার আগে কি দেখে যেতে পারবো? পারবো, পারতেই হবে…

Comments

Avatar

ইসমাইল হাসান

সবার উপরে বিজ্ঞান সত্য, তাহার উপরে নাই...

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x