আমরা অনেকেই জানি হালদা নদীতে প্রতিবছর একটা সময় কার্পজাতীয় মাছ ডিম দিয়ে থাকে। কিন্তু কেন বা কী কারণে কার্পজাতীয় মাছ হালদায় ডিম দেয় তা আমাদের অনেকেরই অজানা। আসুন, হালদার কিছু রহস্যময় তথ্য জেনে নিই…
সালদার পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। হালদা নদীর কিছু ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যই এই নদীকে মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী করে তুলেছে। ভৌত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এই নদীর অনেকগুলো বাঁক যেগুলোকে “অক্সবো” (Ox-bow) বাঁক বলে। এই বাঁকগুলোতে স্রোতের ফলে প্রচণ্ড ঘূর্ণন সৃষ্টি হয় যা গভীর স্থানের সৃষ্টি করে। স্থানীয় ভাষায় গভীর স্থানগুলোকে “কুম” বা “কুয়া” বলা হয়। উজান হতে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে এসে জমা হয় ফলে পানি ফেনিল ও ঘোলাটে হয়ে যায়। মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয়।
তাছাড়া এক গবেষণায় দেখা গেছে হালদা নদীর গভীরতা ও গঠন এমন যে কিছু কিছু স্থানে পানির চতুর্মুখী বা ত্রিমুখী ঘূর্ণন এর সৃষ্টি হয় যেগুলোকে ভর্টেক্স জোন (Vortex zone) বলা হয়। এই ঘূর্ণনের ফলে হালদা নদীতে বহুমুখী স্রোতের সৃষ্টি হয় যা মাছকে ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এইরকম বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আর কোনো নদীতে পাওয়া যায় না। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ী ঝর্ণা বা ছড়া এবং প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব।
অনেকগুলো পাহাড়ী ঝর্ণা বিধৌত পানি প্রচুর জৈব উপাদান এবং ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান নদীতে বয়ে আনে যার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়। এইসব পুষ্টি উপাদান মাছের প্রজনন-পূর্ব জননাঙ্গের পরিপক্কতায় সাহায্য করে। রাসায়নিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম পরিবাহিতা, সহনশীল পরিমাণের দ্রবীভূত অক্সিজেন, সহনশীল অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব ইত্যাদি।
মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে “তিথি” বলা হয়ে থাকে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয় ভাষায় “জো” বলা হয়। এই জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা, সেই সাথে নদীর উজানে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত (Thunder-storm)। এর ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয় যাতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনা আকারে প্রবাহিত হয়। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে ফেলে।
মাছের ডিম ও রেণু সংগ্রহের উপযুক্ত সময় হল বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার প্রবল বর্ষণ। এসময় নাজিরহাট, সাত্তারহাট, আজিমারঘাট, বৈদ্যের হাট, রামদাশ মুন্সীরহাট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মিহি মশারির নেট দিয়ে ডিম ও রেণু নৌকায় সংগ্রহ করা হয়। এরপর ডিমগুলোকে নৌকার মাঝখানে কাঠের তক্তা ও মাটির প্রলেপ দ্বারা তৈরি কৃত্রিম পুকুরে বা চৌবাচ্চায় রাখা হয় যেখানে মিহি সুতা দিয়ে তৈরি জালের আবরণ থাকে। রেণুগুলোকে মাটির পাত্রে রাখা হয়। ডিম ও রেণুগুলো সংগ্রহ করার পর মাটির তৈরি অগভীর কুয়ায় ডিমগুলো ছেড়ে দেয়া হয়। এখানেও মিহি সুতা দিয়ে তৈরি জালের আবরণ থাকে একটা স্তর পর্যন্ত। ডিম ফুটানোর জন্য ২-৩ ঘণ্টা পর পর নাড়াচাড়া করা হয়। এভাবে ১৭-১৮ ঘণ্টা পর ডিম ফুটে রেণুগুলো মিহি সুতোর জাল পেরিয়ে নিচের পানিতে চলে যায়। এরপর জালটি তুলে নেয়া হয়। এসময় রেণুর রঙ থাকে সাদা। এক পর্যায়ে রেণুগুলোকে আরেকটি কুয়ায় স্থানান্তর করা হয়। কুয়ার পানি নির্দিষ্ট সময় পর পর পরিবর্তন করা হয়। যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ৭ দিনের মধ্যে রেণুগুলো বাজারজাতকরণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
রহস্যময় এ পৃথিবীতে হালদা নদীও অপার এক রহস্যের সমাহার। এই নদী বাংলাদেশের অনন্য এক সম্পদ যা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
অন্তর সরকার
ফিশারিজ ২য় বর্ষ,
“চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়”