অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই যে আমরা চাঁদে গেছি, মঙ্গলে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এর জন্য যে অঢেল অর্থ ও সময় ব্যয় করছি- এসবের দরকার কী? এই অর্থ আর সময় মহাশূন্যে না ঢেলে পৃথিবীতে ঢাললে তো আমরা পৃথিবীকে এতো দিনে স্বর্গ বানিয়ে ফেলতে পারতাম। হুম, খুবই যৌক্তিক কথা। পৃথিবীরই যেখানে অনেক কিছু উদঘাটন করা বাকী, সেখানে শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আমরা কেন এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি?
অনেকেই মনে করেন মহাকাশ গবেষণায় যে কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢালা হচ্ছে তার পুরটাই গচ্চা যাচ্ছে। অনেকের কাছেই মঙ্গলগ্রহে পানি পাওয়ার ঘটনা নিতান্তই তুচ্ছ। এতো দূরের বসবাস অযোগ্য গ্রহে পানি থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী! হয়তো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মেশিনে ধরতে পারার ঘটনাও ওদের কাছে অর্থহীন। আমার মনে হয় মহাশূন্য গবেষণার দর্শন এবং মহাকাশ গবেষণায় মানবজাতির অর্জন নিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে কিছু সত্য তুলে ধরার এখনই সময়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেখানে প্রতিনিয়ত দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আসলে মহাকাশ গবেষণা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে জানার চেষ্টা, দূর গ্রহে অভিযান চালোনোর ইচ্ছা আমাদের মধ্যে অনেক আগে থেকে বাস করা প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। এই প্রবণতা আদিম, যা একসময় আমাদের প্রজাতিকে আফ্রিকা ছেড়ে অন্য মহাদেশে পাড়ি জমাতে প্ররোচিত করেছিল। এর জন্যই আমাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল, আমাদের উন্নতির পথ খুলে গিয়েছিল, আমরা জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছিলাম। আর এভাবেই সত্তর হাজার বছর আগে ঘটলো বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব।
নিশ্চিতভাবেই মহাশূন্যে আমাদের বিভিন্ন অভিযান আমাদের কৌতূহল ও রোমাঞ্চপ্রিয়তার বহিঃপ্রকাশ। আর এর অন্যতম প্রয়োজনীয়তা হলো আমাদের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখা। যেকোনো সময় কোনো বড় গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে, কিংবা বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাতে আমাদের মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মোটেই অবাক ব্যাপার না। আপনি যে পৃথিবীকে ভাবছেন কেউ হয়তো আমাদের জন্য নিখুঁতভাবে গড়ে দিয়েছে, সেই পৃথিবীতেই এই পর্যন্ত পাঁচটি গণ-বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯৯% প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে [১]। তার মধ্যে অনেক মানব প্রজাতিও আছে।
মহাকাশ গবেষকরা এ পর্যন্ত মানবজাতির উপকারের জন্য কী করলো এমন প্রশ্ন মনে আসা খুবই স্বাভাবিক। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে নাসা(NASA) খুবই সুপরিচিত একটি সংস্থা। এটি যেখানে আমেরিকার গর্ব সেই খোদ আমেরিকারই বহু লোক মনে করে নাসার ফান্ডিং বন্ধ হওয়া উচিৎ। কিন্তু নাসার অনেক কর্মকাণ্ডই কিন্তু মনুষ্যত্বের পক্ষে।
নাসার প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট পৃথিবীকে সর্বক্ষণ প্রদক্ষিণ করছে। নাসার গবেষকরা সেসব স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্য থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। সে সব তথ্য ব্যবহার করে জলবায়ু, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে আরও ভাল ভবিষ্যতবাণী করার উপায় বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে যেসব কথা শোনা যায় তার জন্য কিন্তু নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব দাবী করা মানুষেরাই অনেকাংশে দায়ী। নাসার পৃথিবী সংক্রান্ত গবেষণার একটি অংশ হল জলবায়ু পরিবর্তনের উপর নজর রাখা এবং আমাদের সতর্ক করে দেওয়া। তাদের স্যাটেলাইট ডাটা দ্বারাই আজ প্রমাণিত যে বিশ্ব উষ্ণায়ন আসলেই হচ্ছে, যা অনেক রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থে অস্বীকার করে।
এছাড়া বর্তমানে যোগাযোগ প্রযুক্তির যে অভাবনীয় উন্নতি দেখছেন তা অনেকটা সম্ভব হয়েছে মহাকাশ গবেষণার পথ ধরেই। আকাশপথ যাতায়তের ক্ষেত্রে এখন অন্যতম সহজ একটি পথ এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত ভ্রমণের ক্ষেত্র বিমান হচ্ছে দ্রুততম একটি অপশন। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে আমাদের আকাশপথও দিনে দিনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিমানগুলো উড়ালের সময়ে নিখুঁতভাবে দিক নির্ণয় এবং সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর উপর অনেকখানি নির্ভর করে। মহাকাশ গবেষণা না থাকলে হয়তো আমরা এতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পেতাম না। ইন্টারনেট সুবিধার কথা না হয় বাদই দিলাম।
সেই সাথে পৃথিবীর কক্ষপথে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে থাকা গবেষকদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন, জিরো গ্রাভিটিতে শরীরের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি থেকে মানব দেহের জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে এবং তা চিকিৎসাবিজ্ঞানকেও অগ্রসর করছে। এছাড়া LED, Infrared Ear Thermometer, কৃত্রিম অঙ্গ, উন্নত সিমুলেশন, উন্নত খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতি এসেছে মহাকাশ গবেষণার পথ ধরে[২]। এই পথ ধরে হয়তো আমরা ভবিষষ্যতে সৌরশক্তিকে কাজে লাগানোর আরও উন্নত ও কার্যকরী কৌশল পেয়ে যেতে পারি। জানেনই তো প্রযুক্তি নির্ভর এই সভ্যতা চালানোর জন্য চাই নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির যোগান।
মহাশূন্য অভিযান আমাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ করে দিয়েছে। নভোচারীরা যখন মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর দিকে তাকায় তারা এই নীল গোলকের মত গ্রহটি সম্পর্কে আলাদা এক অনুভূতি পায়। ভিন্ন এক প্রতিক্রিয়ায় তাদের মন আবেশিত হয়। এই প্রতিক্রিয়ার নাম Overview Effect বা পূর্ণদর্শন প্রভাব। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখলে মনে হয় মানচিত্রের সীমানাবিহীন একটি গ্রহ। অথচ ভূমিতে আমরা দেশ, জাতি, ধর্ম ও মতাদর্শের ভিত্তিতে কত বিভেদ সৃষ্টি করেছি! নিজেরাই নিজেদের মাঝে দেয়াল গড়ে তুলেছি। মহাশূন্যে পর্যটন ব্যবস্থা অগ্রসর হলে হয়তো আমরা আমাদের বিভেদ ভুলে নিজেদের শুধুমাত্র একটি দেশের নয়, সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক নাগরিক মনে করতে পারবো।
তবে আরও কিছু অভিজ্ঞতা হয় নভোচারীদের। যেমন স্পেস স্টেশনে থাকা নভোচারীদের চোখে পৃথিবীতে ঘটা অরণ্যবিনাশ, খরা বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুব পরিষ্কার ভাবে ধরা দেয়। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে খুব ভালোভাবেই বোঝা যায় আমরা মানুষেরা পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিজেদের স্বার্থে কত অত্যাচার করছি। হয়তো মহাশূন্য অভিযানগুলো থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা আমাদের এই বাসস্থান মাতৃসম পৃথিবীকে আরেকটু ভালবাসতে শেখাবে।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে আমাদের মহাশূন্যের দিকে যাত্রার শুভ সূচনা। তখন থেকে এ পর্যন্ত আমাদের প্রযুক্তি ব্যাপক উন্নত হয়েছে। আমাদের জ্ঞানের পরিসীমা আরও বিস্তৃত হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখছি কোনো এক সময়ে আমরা হয়তো আন্তঃনক্ষত্রিক ভ্রমণে বের হবো। আর এই যাত্রায় আমাদের পরবর্তী বড় পদক্ষেপ হলো মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পা রাখা।
তথ্যসূত্রঃ
১) https://www.nytimes.com/2014/11/09/opinion/sunday/prehistorys-brilliant-future.html
২) https://spinoff.nasa.gov/Spinoff2008/tech_benefits.html