নামটা শুনে অনেকেরই চেনা চেনা মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ইনি বিখ্যাত চিকিৎসক এবং শারীরবিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে, যিনি প্রথম মানব শরীরের রক্ত সংবহন প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তাঁর আবিষ্কারের পথটি কিন্তু সুগম ছিলো না। ভাবুন তো একবার, এই প্রক্রিয়া জানা না থাকলে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের কি হাল হতো! এখনকার আধুনিক অস্ত্রোপচার তো সম্ভবপর হতোই না, এমনকি আমাদের শরীরের ঠিক কোন জায়গায় কোন রক্তবাহে ইনজেকশন দিতে হবে তাও আমরা বুঝতে পারতাম না! এই মহান বিজ্ঞানীর জীবন ও কর্ম নিয়েই আজ আমার এই কাহিনীঃ
জন্ম ও শৈশব:
ইংল্যান্ডের ফোকস্টোন শহরে থমাস হার্ভে (Thomas Harvey) নামক এক নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। সুখ্যাতির জোরে পরে তিনি ফোকস্টোন শহরের মেয়র পদেও নির্বাচিত হন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল জোয়ানে হাওকে (Joane Haoke)। ১৫৭৮ সালের ১লা এপ্রিল জোয়ানে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। নাম তাঁর উইলিয়াম হার্ভে (William Harvey)।
উইলিয়াম ছোটবেলায় ফোকস্টোনের এক বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাঠ শুরু করেন। ১০ বছর বয়সে তিনি ক্যান্টেরবেরি শহরের বিখ্যাত King’s Grammar School-এ ভর্তি হলেন। এই সময় তিনি তাঁর কাকার বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই তিনি কাকার কাছে লাতিন ভাষা শিখতে শুরু করেন। কারণ, তখন সমগ্র ইউরোপে জ্ঞানচর্চার জন্য লাতিন ভাষা ছিলো অপরিহার্য।
চিকিৎসাবিদ্যায় হাতে খড়ি:
১৫৯৩ সালে ১৫ বছর বয়সে হার্ভে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসেবে যোগ দিলেন। এই সময় পড়াশুনা চালানোর জন্য একটা পয়সাও তাঁর নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হলো না। কারণ, তিনি এমন এক স্কলারশিপ লাভ করেন যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ৬ বছরের জন্য তাঁর লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করে। ৬ বছরের শেষ দু’বছর উইলিয়াম জ্ঞানলাভের আশায় ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালি ভ্রমণ করেন।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ২১ বছর বয়সে তিনি ইতালির পাদুয়া (Padua) বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে স্থানান্তরিত হলেন। সেই সময় পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো ইতালির সেরা। গ্যালিলিওর মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী তখন সেখানে অধ্যাপনা করেন। গ্যালিলিওর স্বাধীন চিন্তাধারার প্রভাব পরবর্তীকালে উইলিয়ামের জীবনেও লক্ষ্য করা যায়।
হার্ভে এখানে এসে তাঁর শিক্ষক হিসেবে পেলেন ফেব্রিসিয়াস (Heironymus Fabricius)-কে।ফেব্রিসিয়াস তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৫৭৪ সালে তিনিই প্রথম মানুষের শিরায় কপাটিকার (valve) আবিষ্কার করেন। অবশ্য তা প্রকাশ্যে আসে ১৬০৩ সালে। কপাটিকা হলো একমুখী দরজার মতো। অর্থাৎ,এটি যে কোনো একদিকে খুলে যায়। রক্তের প্রবাহের দিক নির্ধারণে, সর্বোপরি রক্ত সংবহন প্রক্রিয়ায় এই কপাটিকার ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। খুব শীঘ্রই হার্ভে ফেব্রিসিয়াসের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন এবং ১৬০২ সালে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
চিকিৎসক জীবনের শুরু:
১৬০২ সালে হার্ভে নিজের দেশে ফিরে এসে কেমব্রিজ থেকেও চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৬০৪ সালে লন্ডনের ‘কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস’-এ নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেন্ট বার্থোলোমিউ হাসপাতালের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হিসেবে হার্ভের সুখ্যাতি সারা ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর খবর ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের কানে যাওয়া মাত্রই তিনি হার্ভেকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীকালে তাই হার্ভে রাজা চার্লসের চিকিৎসক হিসেবেও নিযুক্ত হন।
“রক্ত সংবহন একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া,হৃৎপিণ্ড যাতে প্রধান ভূমিকা পালন করে” — বৈপ্লবিক চেতনার শুরু
গ্যালেন (Galen) নামে বহুকাল আগে এক চিকিৎসক ছিলেন। তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, খাদ্য যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তখন তা রক্ত উৎপাদন করে এবং এই রক্ত যকৃৎ বা লিভার থেকে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছায়। হৃৎপিণ্ড রক্তকে গরম করে এবং অবশেষে কেবলমাত্র শিরার মাধ্যমে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। রক্ত কেবলমাত্র লালচে রঙেরই হয়।
তখনকার মানুষ ১৪০০ বছর আগে দেয়া গ্যালেনের এই তত্ত্বকেই কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া একবাক্যে মেনে নিতো। বিশ্বাস করা হতো, গ্যালেন ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি।
হার্ভে ছিলেন উল্টো ধাতুতে গড়া। তাঁর মনে এ বিষয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করলো। তিনি স্থির করলেন এ বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার। কিন্তু সে কাজ যে সহজ নয়! কারণ, মানব শরীরের ব্যবচ্ছেদ ছাড়া দেহের প্রতিটা অঙ্গের খুঁটিনাটি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। আর জীবন্ত মানুষের ব্যবচ্ছেদ খুবই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া, কারণ তখনকার দিনে অচেতন করার কোনো প্রক্রিয়া বা অ্যানাস্থেশিয়া আবিষ্কৃত হয়নি। এদিকে মৃত মানব শরীরের ব্যবচ্ছেদ করলেও তা সমাজবিরোধী –স্বর্গে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাছাড়া, হার্ভের আগে ১৫৫৩ খ্রীষ্টাব্দে মাইকেল সারভেদো (Michael Servedo) নামক এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাঁর ‘Christiansmi Resitutio’ নামক বইতে গ্যালেনের তৈরি মতবাদের উপরে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ১৬১৬ সালে তিনি জনসমক্ষে জানান যে, গ্যালেনের মতবাদ ভ্রান্ত, তিনি সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। ঈশ্বরের প্রতিনিধির মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ করায় সারভেদোকে পুড়িয়ে মারা হয়। বোঝাই যাচ্ছে, সেই সময় দাঁড়িয়ে হার্ভের পক্ষেও তাই সমাজবিরুদ্ধ কাজ করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিলো না। তাই তিনি এমন একটা উপায় বার করলেন যাতে “সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে”। তিনি জীবজন্তুর শরীরের ব্যবচ্ছেদ করে তাঁর পরীক্ষা শুরু করেন।
১৬২৮ সালে ৫০ বছর বয়সে হার্ভে প্রকাশ করলেন তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘Exercitatio Anatomica de Moto Cordis er Sanguinis in Animalibus’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘প্রাণীজগতের রক্ত এবং হৃৎপিন্ডের গতি সম্বন্ধীয় পর্যবেক্ষণ’, যা সূচনা করলো এক বৈপ্লবিক চেতনার। হার্ভেই প্রথম সঠিক এবং বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে রক্ত হৃৎপিন্ড থেকে ফুসফুসে যায় এবং পরে ফুসফুস থেকে হৃৎপিন্ডে ফিরে এসে তা আবার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া।
তাঁর গবেষণার মূল তথ্যগুলি হলো:
রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনীর মাধ্যমে ফুসফুসে যায় এবং শিরার মাধ্যমে আবার হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। পরে তা আবার ধমনী, উপ ধমনী, শিরা, উপশিরার মাধ্যমে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে।
এই চক্রাকার পদ্ধতির মাধ্যমে কেবলমাত্র রক্তের চলাচল হয়, বায়ুর নয়। রক্তের মধ্যে বায়ু মিশ্রিত থাকলেও তা রক্তই।
হৃৎপিণ্ড রক্ত সংবহনের উৎস, যকৃৎ নয়।
হৃৎপিণ্ড সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত সংবহনে সাহায্য করে। হৃৎপিণ্ডর সংকোচনকে সিস্টোল ও প্রসারণকে ডায়াস্টোল বলে।
হৃৎপিণ্ড যখন রক্ত পাম্প করে আমাদের শরীরে প্রবাহিত করে তখন আমাদের হাতের Pulse অথবা নাড়ী রক্তপূর্ণ হয়। ফলে নাড়ী স্ফীত হয়ে ওঠে।
নাড়ীর গতি বন্ধ হলে হৃদপিণ্ডের গতিও বন্ধ হয়ে যাবে।
শিরার মধ্যে দিয়ে রক্তের দ্বিমুখী চলাচল হয় না। প্রত্যেক শিরার মধ্যে দিয়ে রক্ত কেবল একমুখেই চলাচল করে।
রক্তের রং দু’রকমের হয়। বিশুদ্ধ রক্ত লালচে হয়,আর অশুদ্ধ রক্তের রং কালচে হয়।
এগুলোর প্রত্যেকটিই গ্যালেন বিরোধী। কিছুদিনের মধ্যেই এই খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।প্রথমে কেউ তাঁর এই ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি, সবাই তাঁকে কটূক্তি করতে শুরু করে। লন্ডনের হাতুড়ে চিকিৎসকের দল তো তাঁকে “বন্ধ উন্মাদ” আখ্যা দিয়েই দিয়েছিলো।
বিপ্লবের আগুন কোনোদিন থেমে থাকে না। উইলিয়াম দমবার পাত্র নন। তিনি নিজের ঘরে বসে গবেষণা চালাতে লাগলেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত না হওয়ার ফলে হার্ভে ঠিকমতো বুঝতে পারেননি যে কী করে ধমনী থেকে রক্ত শিরায় প্রবাহিত হয়। তিনি অনুমান করেছিলেন, হয়তো ওখানে কোনো ক্ষুদ্র সংযোগ নালি অবস্থিত। অবশেষে তাঁর ধারণাই সত্যি হয়। ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দে ইতালীয় শারীরবিজ্ঞানী মারসেলো ম্যালপিজি (Mercello Malpighi) এই ক্ষুদ্র সংযোগ রক্ষাকারী রক্তবাহের আবিষ্কার করেন, যেটাকে আমরা এখন রক্ত জালক বলি।
১৬৫১ সালে ৭৩ বছর বয়সে উইলিয়াম হার্ভে তাঁর কিছু ছাত্র নিয়ে একটি শারীরবিজ্ঞানের গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুললেন। ক্রমেই ছাত্রদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই ছাত্ররাই পরে হার্ভের মতবাদকে সমগ্র বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো। তবে হার্ভের আবিষ্কারের ২০০ বছর পরেও বেশ কিছু চিকিৎসক গ্যালেনের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
১৬৫৭ সালের ৩রা জুন ৭৯ বছর বয়সে লন্ডনে এক ভাইয়ের বাড়িতে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত রোগের কারণে হার্ভে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিলো না। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে শত শত বাধা এসেছে। স্ত্রী এলিজাবেথ তাঁর মৃত্যুর আগেই মারা যান, সমগ্র লন্ডনের চিকিৎসক তাঁকে উপেক্ষা করতে শুরু করে, তাঁর পেশা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি। নিরলস ভাবে সমগ্র মানবজাতির উন্নতির লক্ষ্যে শেষ বয়সেও গবেষণা চালিয়ে গেছেন। বিপ্লবের বীজ রোপণ করেছেন। যে বিপ্লব মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, যে বিপ্লব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় — ধর্ম কোনোদিন বৈজ্ঞানিক সত্যকে আটকে রাখতে পারেনি আর পারবেও না। যতই ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগুক, যতই সমাজ কটূক্তি করুক, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কোনোদিন রুদ্ধ করা সম্ভব নয়–“রাস্তা কারও একার নয়”।আর সেই রাস্তা ধরেই যুগ যুগ ধরে যারা এগিয়ে চলেছেন তাদের মধ্যে একজন উইলিয়াম হার্ভে–বিপ্লবের আরেক নাম।
তথ্যসূত্র:
http://www.historyextra.com/…/william-harvey-reveals-circul…
https://www.famousscientists.org/william-harvey/
https://en.m.wikipedia.org/wiki/William_Harvey
http://www.historylearningsite.co.uk/a-history-of-medici…/…/
https://youtu.be/7NOU4McjtXs
জীববিজ্ঞান পরিচয় : দত্ত,রথ,গাঙ্গুলী