পর্ব ১ঃ এখান থেকে পড়তে পারেন।
গত পর্বে বলেছিলাম, ৩১,৫০০ প্রজন্মে এসে Cit+ মিউট্যান্ট জন্মানোর হার এতই বেড়ে গেলো যে, তারা ঐ মিডিয়ামের একটা strain বাদে বাকি সব strain-এর ব্যাকটেরিয়াকে সংখ্যার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেলো। এখন কথা হলো, কেন তারা একটা নির্দিষ্ট strain-কে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি? পারেনি কারণ ঐ strain-এর ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেরা বিবর্তিত হয়ে নতুন একটা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেছে। তারা বিবর্তিত হয়েছে পরিবর্তিত পরিবেশের নতুন উপাদানগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য। যখন থেকে Cit+ মিউট্যান্টরা গ্লুকোজের বদলে গ্রোথ মিডিয়াম হিসেবে সাইট্রেট ব্যবহার শুরু করলো, তখন থেকে বাহ্যিক পরিবেশে তিন ধরণের নতুন অণু দেখা গেলো। এগুলো গ্লুকোজ গ্রহণকারী ব্যাকটেরিয়ার বেড়ে উঠার স্বাভাবিক পরিবেশকে পরিবর্তিত করে দিচ্ছিলো। অণু তিনটি হল – সাক্সিনেট (succinate), ফিউমারেট (fumarate) এবং ম্যালেট (malate)।
এই অণুগুলো কীভাবে উৎপন্ন হচ্ছে, সেটা একটু বলা দরকার।
আগের পর্বে উল্লিখিত “antiporter” প্রোটিনের কাজ হলো, একটা অণুর বদলে আরেকটা অণুকে কোষাভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া। Cit+ মিউট্যান্টের ক্ষেত্রে এই প্রোটিন সাক্সিনেট, ফিউমারেট এবং ম্যালেট নামক তিনটি ছোট এবং কম গুরুত্বপূর্ণ অণুর যেকোনো একটার বদলে সাইট্রেটকে কোষাভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো (অর্থাৎ যে সাইট্রেটকে তারা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কোষের ভেতর নিতে পারতো না, সে সাইট্রেটকে তারা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কোষের ভেতর নেওয়ার সামর্থ্য লাভ করলো)। এর ফলে যে অণুর বদলে সাইট্রেট ঢুকতে লাগলো, সে অণুকে ব্যাকটেরিয়াগুলো কোষ থেকে বাইরে বের করে দিতে লাগলো। এভাবে বাইরের পরিবেশে এই তিনটা অণুর উপস্থিতি দেখা গেলো।
এখন, যারা সাইট্রেট ব্যবহার করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারেনি (সাইট্রেট ব্যবহারে সমর্থ হওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, মানুষ হঠাৎ গাছের বাকল খাওয়ার সামর্থ্য অর্জন করলো!), তাদের মধ্যে একটা strain এই তিন অণুকে ব্যবহার করার উপায় আবিষ্কার করে ফেললো! DctA নামক একটা পরিবাহক (transporter) প্রোটিন তৈরি করে এরা খুব কম শক্তি খরচের মাধ্যমে সাক্সিনেট, ফিউমারেট এবং ম্যালেটকে কোষের ভেতর নিয়ে যেতে শুরু করলো। এভাবে তারা নিজেদের জন্য শক্তি সরবরাহের রাস্তা তৈরি করলো।
কিন্তু নাটকের এখানেই শেষ নয়!
এবার সাইট্রেট ব্যবহারকারী Cit+ মিউট্যান্টের দলও প্রচুর পরিমাণে DctA তৈরি করতে লাগলো, যেন সাইট্রেট ব্যবহার করতে গিয়ে তারা যে সাক্সিনেট, ফিউমারেট এবং ম্যালেট হারাচ্ছিলো, সেগুলোর কিছুটা হলেও ফিরিয়ে নিতে পারে।
এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, বিবর্তন এবং বাস্তুসংস্থানকে (ইকোসিস্টেম) পরস্পর থেকে আলাদা করে ভাবা সম্ভব নয়।
“আমাদের গবেষণা দেখিয়েছে, কীভাবে একটি বিবর্তন আশেপাশের পরিবেশকে বদলে দিতে পারে। এর ফলে কীভাবে জন্ম নিতে পারে জীববৈচিত্র্য, কীভাবে একটি ইকোসিস্টেমের প্রকৃতি বদলে যেতে পারে, কীভাবে পাশাপাশি বসবাসরত প্রাণীদের বিবর্তনের পথ পরিবর্তিত হতে পারে।” বলেছেন লেন্সকি ও তার দল।
তারা এই বিবর্তনকে তুলনা করছেন প্রায় ২.৪ বিলিয়ন বছর আগে ঘটা সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়ার বিবর্তনের সাথে। সে সময় সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভবের কারণেই পৃথিবীতে অক্সিজেন নির্গত হতে শুরু করেছিলো, আর প্রাণীদের বিবর্তনের গতিপথ বদলে গিয়েছিলো। এখানেও সাইট্রেট গ্রহণকারীরা গ্রোথ মিডিয়ামকে পরিবর্তিত হতে সাহায্য করেছে, এবং ঐ মিডিয়ামে বসবাসরত অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার বিবর্তন পথকে বদলে দিয়েছে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অভিযোজিত হওয়ার যে ধারণাটা ডারউইন দিয়েছিলেন, এই ফলাফলটা সেই ধারণার একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এখন, গবেষণা শুরুর ২০ বছর পর ৬৩,৩৬৩.৩ টি প্রজন্ম পার করে ব্যাকটেরিয়াগুলো পূর্বপুরুষদের তুলনায় ৮০% দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।
লেন্সকি ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, সাইট্রেট সবসময়ই গ্রোথ মিডিয়াম হিসেবে গ্লুকোজের পাশাপাশি ছিল। ফলে ১২ টা পপুলেশনের সবারই সমান সংখ্যক সুযোগ ছিল সাইট্রেট ব্যবহার করার সক্ষমতা অর্জন করার। কিন্তু দেখা গেলো, মাত্র একটা পপুলেশনই এই ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে।
আর এই বিবর্তন ঠিক কোন প্রজন্ম থেকে ঘটা শুরু করেছে, কিংবা কবে থেকে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পরিবর্তন আসছিলো, সেটা জানার জন্য লেন্সকিকে আশ্রয় নিতে হয়েছে জেনেটিক্সের।
কিন্তু এতো বিষয় থাকতে জেনেটিক্স কেন?
কারণ সব জীবিত প্রাণীই তাদের ক্রোমোজোমের মধ্যে জীন বহন করে। এই জীন তৈরি হয় ডিএনএ বেস (base) দিয়ে, আর ঠিক করে দেয় কোন প্রজাতি কীভাবে বেড়ে উঠবে, তার আকার-আকৃতি-চেহারা কেমন হবে। এসব তথ্য বংশ পরম্পরায় মা-বাবার জীন থেকে সন্তানের জীনে প্রবাহিত হতে থাকে। যেমন, একটা মা মুরগী যখন নিজের ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়, তখন সেই জন্ম নেওয়া বাচ্চার মধ্যে মুরগীসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে আসে? আসে মা মুরগীর জীনের মাধ্যমে। মায়ের জীন থেকে পাখনা গজানো, পালক গজানো, ঠোঁট চোখা হওয়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য বাচ্চা মুরগীর জীনে প্রবাহিত হয়। সে অনুযায়ী জীন বাচ্চাটির আকৃতি-চেহারা তৈরি করে। ফলে মুরগীর ডিম থেকে কুমীরের বাচ্চা বেরোনোর কোনো আশা নেই।
গত শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জীনের তালিকা তৈরি করেছেন। দেখা গেছে, প্রতিটি জীবিত প্রাণী তাদের ডিএনএ-তে হুবহু একই উপায়ে তথ্য জমা রাখে। তারা সবাই একই “জেনেটিক কোড” ব্যবহার করে। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে একই (same gene) জীন দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, মানবদেহের ডিএনএ-তে যেসব জীন পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই পাওয়া সম্ভব গাছ, শস্য, প্রবাল, জলহস্তী, কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দেহে।
এই দুটো ব্যাপার থেকে বুঝা যায়, আধুনিক প্রাণীরা এসেছে একটা আদি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে। “Last universal ancestor” নামে পরিচিত এই পূর্বপুরুষ বেঁচে ছিলো বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে।
কোন প্রাণীর সাথে কোন প্রাণীর জীনের মিল বেশি, সেটা হিসেব করলে ঐ দুই প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক জানা যায়। যেমন, অন্যান্য প্রাণীর জীনের চেয়ে এইপ-দের (চিম্পান্জি, গরিলা) জীনের সাথে মানুষের জীনের মিল অনেক বেশি, প্রায় ৯৬%। এ থেকে বুঝা যায়, ওরা আমাদের সবচেয়ে নিকট আত্মীয়।
বর্তমানে আমাদের সাথে চিম্পান্জির যে ৯৬% জীনগত মিলের সম্পর্ক, সেটা সময়ের সাথে প্রজাতির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের ফলে ঘটেছে। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামের ক্রিস স্ট্রিনজার জানতে চেয়েছেন, “এই সম্পর্ককে অন্য কোনো উপায়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন কি?” এরপর তিনি বলেন, “মানুষ এবং চিম্পান্জির একজন সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল। তার থেকেই আমরা এবং চিম্পান্জিরা দুটো আলাদা দিকে বিবর্তিত হয়েছিলাম।”
জেনেটিক্স ব্যবহার করেও আমরা বিবর্তনের ফলে ঘটা পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিন-এর প্রফেসর ন্যান্সি মোরান-এর মতে, বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়ার জাত আলাদা হলেও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক common জীন থাকে (shared genes)। সেগুলোকে শনাক্ত করে গবেষণার মাধ্যমে বের করা যায়, কীভাবে একই জীনযুক্ত ব্যাকটেরিয়া হতে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভব হলো।”
যখন লেন্সকি তার E. coli ব্যাকটেরিয়ার নমুনা পরীক্ষা করলেন, তখন দেখলেন, সাইট্রেট হজমকারী ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যেগুলো অন্য ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে নেই! এই পরিবর্তনগুলোকেই মিউটেশন বলে। এসব মিউটেশনের কয়েকটা ঘটেছিলো “সাইট্রেট হজম করার ক্ষমতা” তৈরি হওয়ার অনেক আগে। লেন্সকির মতে, এসব মিউটেশন নিজেরা ব্যাকটেরিয়াকে সাইট্রেট হজম করার ক্ষমতা দেয়নি। বরং পরবর্তীতে যেসব মিউটেশন এই ক্ষমতা প্রদান করেছে, তাদের কাজের জন্য পরিবেশ তৈরি করেছিলো।
এটা বিবর্তন সম্পর্কে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরে। সেটা হল, প্রাণীর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট বিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হওয়াকে চরম অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ প্রাণীকে যদি উক্ত বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়, তাহলে কেউ না কেউ ঠিকই বৈশিষ্ট্যটি গ্রহণ করবে। আর মজা কী, জানেন? ঐ একজনকে দিয়েই হবে বাজিমাৎ!
লেন্সকির E. coli ব্যাকটেরিয়া দেখিয়েছে যে, বিবর্তনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের ক্ষমতা জন্মাতে পারে। কিন্তু বিবর্তন যে সবসময় ভালো কিছুই ঘটাবে, প্রজাতিকে উপকারী বৈশিষ্ট্য প্রদান করবে, এটা সম্পূর্ণ ভুল। বিবর্তনের ফলাফল হয় এলোমেলো। মোরানের মতে, যেসব মিউটেশনের কারণে প্রাণীর দেহে পরিবর্তন ঘটে, সেসব মিউটেশন খুব কম সময়েই ভালো ফলাফল বয়ে আনে। বাস্তবে দেখা যায়, প্রাণীর শারীরবৃত্তীয় কাজে বেশিরভাগ মিউটেশনেরই কোনো প্রভাব নেই, বা থাকলেও সেটা নেতিবাচক।
চলবে…।
মূল প্রবন্ধঃ How do we know that evolution is really happening?
এই পর্বে চোখের সামনে কিছু ঘটেনি।
পোস্ট পড়ে কমেন্ট করলেন কিনা বুঝা গেল না। কারণ সাইট্রেট ব্যবহারকারী ব্যাকটেরিয়ার মিউটেশন চোখের সামনেই ঘটেছে।