আলবার্ট আইনস্টাইন; পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত প্রবাহধারাকে পরিবর্তন করে দেয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, অথচ এই জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম শুনেননি, এমনটি হতেই পারে না। শুধু বিজ্ঞান কেন, যে কোনো শিক্ষিত ব্যক্তিই আইনস্টাইনকে চেনেন বলে আমার ধারণা। নামটি শুনলেই মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠে E=mc2 সূত্রটি। মনের কোণে উঁকি দেয় আপেক্ষিকতার ধারণা।
আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত “সময় আপেক্ষিক” এই বাক্যটিই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। কিন্তু এর প্রকৃত ব্যাখ্যা কী হতে পারে- তা নিয়ে ধোঁয়াশার সাগরে ডুবে থাকা নতুন কিছু নয়। কারণ এর ব্যাখ্যাগুলো বাস্তব জীবনের সাথে আপাতদৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। আবার এর গাণিতিক প্রমাণও অধিকতর জটিল। তাহলে শুধু মুখস্থ করে তা কথোপকথনে প্রকাশ পর্যন্তই কি সীমাবদ্ধ থাকবে? এর সহজ কোন অভিব্যক্তি নেই? গাণিতিক হিসাবের পরিবর্তে শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে কি তা প্রমাণ করা যায়? কতদূর বিস্তৃত এই ধারণা?
উপরের সবগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ৪০০ বছর পূর্বে। ততদিনে মানুষের মনে এটা গেঁথে গেছে যে, আলোকরশ্মি বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়লে তখনই কেবল আমরা দেখতে পাই। এছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে বেশ কিছু প্রমাণিত তথ্যও মানুষের চিন্তাধারায় স্থান পেয়েছে। এমন সময়, অলে রোমার নামের একজন তরুণ চিন্তাবিদ বৃহস্পতি ও পৃথিবীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রতিনিয়ত গভীর চিন্তায় মগ্ন। তিনি খেয়াল করলেন, বৃহস্পতি গ্রহের নিজ অক্ষে প্রদক্ষিণ করতে কখনো বেশি সময় লাগছে, কখনো কম সময় লাগছে। কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করলেন পৃথিবীর অবস্থান। পৃথিবী ও বৃহস্পতির দূরত্ব যখন কম থাকে তখন সময়ও কম লাগে বলে মনে হয়। দূরত্ব বেশি হলে সময় বেশি লাগে। যেহেতু ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যম হলো আলো, সুতরাং আলোর গতিবেগ আছে। নতুবা দূরত্ব পরিবর্তনেও ঘটনার সময়কালে কোনো পরিবর্তন হতো না। এরপর বিজ্ঞানীরা আলোর বেগের নিখুঁত মান বের করার প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করেন।
পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির মান সেকেন্ডে প্রায় ৩,০০,০০০ কিলোমিটার হিসেবে প্রমাণিত হয়। তবে কঠিন-তরল মাধ্যম ভেদে এই মানের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। তবে শূন্য মাধ্যমে এই মান সর্বোচ্চ এবং বায়ু মাধ্যমেও এই মানটিই ব্যবহার করা হয়। (প্রকৃতপক্ষে এই মান বায়ুমাধ্যমে অত্যন্ত নগণ্য পরিমাণ কমে আসে, যা হিসাব নিকাশে কোনো পরিবর্তন সৃষ্টি করে না বিধায় শূন্য মাধ্যমের গতিটিই ব্যবহৃত হয়)। রোমার যখন আলোর গতি পরিমাপের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন তখন আরেক বিজ্ঞানী নিউটন গতিবিদ্যা নিয়ে চিন্তায় বিভোর। ১৬৮৭ সালে তিনি গতিবিদ্যা সংক্রান্ত তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ভিত গড়ে দেয়। নিউটনের এই আবিষ্কৃত সূত্রে স্থান এবং সময়কে পরম হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। এর সাথে বাস্তবের সম্পূর্ণ মিল থাকায় তা বিজ্ঞানীমহলে মুহূর্তেই গ্রহণীয় হয়। এরপর শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তকারী সকল আবিষ্কার। শুরু হয় সভ্যতার আধুনিকায়ন। শতাব্দীর পর শতাব্দী শেষ হয়। এক সময় এরুপ সম্ভাবনা চলে আসে যে, পদার্থবিজ্ঞানে নতুন করে আবিষ্কারের আর কিছু নেই।
ঠিক এমন সময়ে, উনবিংশ শতকের শেষদিকে ম্যাক্সওয়েল আলোর তরঙ্গ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। আলোকে প্রমাণ করেন তাড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ হিসেবে। শূন্য মাধ্যমে আলোর প্রকৃত গতি নিয়ে মতামত প্রকাশ করেন। আলোর চেয়ে দ্রতগতির কোনো বস্তু পাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করেন। তবে উনি শূন্য মাধ্যমে আলোর যাত্রাপথে ইথার কণার অস্তিত্ব নিয়ে বক্তব্য জানান দেন। তবে পরবর্তীতে মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে ইথার বলতে আসলে কিছু নেই।
এরপর পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আপেক্ষিতার তত্ত্ব বা থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রদান করেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর এই তত্ত্ব এতটাই কল্পনাপ্রবণ ছিল যে, তখনকার সময়ের বিজ্ঞানীদের হিমশিম খেতে হয় তাঁর তত্ত্ব অনুধাবন করতে। এবার চলুন আমরাও কল্পনার সাগরে ডুব দিয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করি ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’।
‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ দুইটি অংশে বিভক্ত। একটি হলো স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি যা ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয়। এবং অপরটি জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি, এটি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়।
‘স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ নামটি থেকেই স্পষ্ট হয় এই থিওরিটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কী সেই বিশেষ ক্ষেত্র? এটা র জন্য জানতে হবে ‘ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স ‘ সম্পর্কে। নামটি একটু জটিল শোনালেও এর বিশেষত্ব খুবই সাধারণ একটি ধারণা। আগেই বলেছি আমরা কল্পনার সাগরে এখন ডুবে আছি। সুতরাং, আমরা যা খুশি কল্পনা করতে পারি। ধরে নিন, আপনার একটি মোটর সাইকেল আছে। আপনি সেটা স্টার্ট দিয়ে চলা শুরু করলেন। আপনি যেহেতু নিরাপদে চালাবেন এই জন্য আপনার গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার (৩০ km/h) রাখবেন। স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথে কি আপনি এই গতি অর্জন করতে পারবেন? নাকি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে? নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ সময় লাগবে ৩০ km/h গতি অর্জনের জন্য। ধরি, এইজন্য সময় লাগল ১০ সেকেন্ড। সুতরাং, এটা নিশ্চিত আপনি ওই ১০ সেকেন্ডের পুরো সময় আপনার গতি শূন্য থেকে প্রতি সেকেন্ডে বৃদ্ধি করে ৩০ km/h এ পৌঁছেছেন। অর্থাৎ, ঐ ১০ সেকেন্ডে আপনার গতি একই ছিল না, প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন আপনার গতি ৩০ km/h এ পৌঁছালো, তারপর আপনি এই গতিই ধরে রাখলেন পরবর্তী সময়ে। অর্থাৎ আপনি সমগতিতে চলছেন। এখন মনে হতে পারে এত সাধারণ কথা এতক্ষণ ধরে বলার কি আছে? আপনি কি জানেন আপনি ইতোমধ্যে ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স সম্পর্কে বুঝে গেছেন? অবাক হলেন? হ্যাঁ, ঠিক তাই। যে সকল বস্তু সমগতিতে চলে তারাই ইনারশিয়াল ফ্রেম। আর যদি ওই ফ্রেমকে কোন কিছুর সাথে তুলনা করার জন্য ব্যবহার করি তাহলেই সেটা ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স। আর একটু স্পষ্ট করা যাক।
আগের উদাহরণে, আপনি এখন ৩০ km/h গতিতে বাইক চালাচ্ছেন। রাস্তার পাশের বিশাল বট গাছটি তো স্থির। ওইটার সাপেক্ষে আপনি গতিশীল। এবার আপনার সাথে আর একটি বাইক নিয়ে আপনার বন্ধু একই গতিতে বাইক চালাচ্ছে। উভয়ই ওই বট গাছটির সাপেক্ষে গতিশীল। কিন্তু আপনারা কি একে অপরের সাপেক্ষে গতিশীল? সময় অতিক্রান্ত হলেও দুইজনের সমগতির জন্য কোনো পার্থক্য তৈরি না হওয়ায় একে অপরের জন্য আপনারা স্থির। অথচ রাস্তার ধারের অন্য কিছুর সাপেক্ষে কিন্তু আপনারা গতিশীল।
একটু চিন্তা করুন, রাস্তার বট গাছটি পৃথিবীর পৃষ্ঠে অবস্থিত। পৃথিবী তো ঘুরছে। তাহলে বট গাছটি কি প্রকৃতপক্ষে স্থির? নিশ্চয়ই না। যেহেতু আমরাসহ আমাদের আশেপাশের সব কিছুকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরছে, তাই আমরা মনে করছি ওইগুলো স্থির। তবে মহাকাশ থেকে দেখলে বোঝা যাবে পৃথিবীসহ ওই বট গাছটিও গতিশীল। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে এমন কোনো বস্তু পাওয়া যাবে না যা প্রকৃতপক্ষে স্থির। সুতরাং পরম স্থির বলে কিছু নেই। সবকিছুই গতিশীল। এদের মধ্যে যারা সমগতিতে গতিশীল তারা ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স; যেমনঃ ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর নিজ অক্ষে একবার আবর্তন কিংবা ৩৬৫ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা ইত্যাদি। আবার পৃথিবীতে থাকা আপাতদৃষ্টিতে কোন স্থির বস্তুও কিন্তু ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স, কারণ তা পৃথিবীর সাথে সমগতিতেই চলছে। সমগতি না হলে নন ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স। এটুকু বুঝতে পারলে অভিনন্দন আপনাকে, আপনি স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির প্রথম ভিত্তিকে বুঝে গেছেন।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্র ব্যবহার করি, যেমনঃ নিউটনের সূত্র, আর্কিমিডিসের সূত্র প্রভৃতি। যে কোনো ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্সে পদার্থবিজ্ঞানের সকল সূত্রের প্রয়োগ ও ফলাফল একই থাকে। এটাই আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির প্রথম স্বীকার্য অর্থাৎ এর ওপর ভিত্তি করেই সূত্র প্রতিষ্ঠিত।
থিওরি অফ রিলেটিভিটির আর একটি স্বীকার্য আছে। এটা বুঝতে হলে কিছুক্ষণ বাসে চড়তে হবে আমাদের। মনে করে নিন, একটি বাস ৫০ km/h গতিতে চলছে এবং আপনি সেই বাসের জানালার ধারে বসে আছেন। রাস্তার ধারে বসে থাকা একটি লোক আপনাকে দেখলে বুঝে যাবে আপনি গতিশীল। এখন আপনি যদি একটি ক্রিকেট বলকে ২০ km/h গতিতে সামনের দিকে ছুড়ে দেন তাহলে বলটির গতি কত হবে? নিশ্চয়ই বাসের গতি + বলটি ছোঁড়ার গতি। অর্থাৎ বলটির গতি হবে ৫০+২০= ৭০ km/h । সুতরাং রাস্তার ধারে বসে থাকা লোকটির কাছে মনে হবে, আপনি ৭০ km/h গতিতে বলটি ছুঁড়েছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয়, রাস্তার ধারের ওই লোকটি অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের কাছে বলের গতি, বাসের গতি ও বল ছোঁড়ার গতির মিলিত যোগফল হিসেবে দেখা গেছে।
এখন আপনি বাসের জানালার ধার থেকে একটি টর্চলাইটের আলো জ্বালালেন সামনের দিকে। তাহলে রাস্তার ধারের লোকটির কাছে আলোর গতি কত হওয়া উচিত? নিশ্চয়ই আলোর গতি+বাসের গতি। তাই নয় কি? পূর্বের উদাহরণ তাই বলে। অর্থাৎ লোকটির কাছে মনে হবে আলোর গতি ৩,০০,০০০ km/s + ৫০ km/h। অর্থাৎ ৩,০০,০৫০ km/s। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের থিওরি অনুসারে আগেই প্রমাণিত আলোর চেয়ে বেশি গতির কিছু হতে পারে না। তাহলে এখানে রাস্তার ধারের লোকটির দেখা ঘটনা সাংঘর্ষিক!!
এখানে বিষয়টি হলো, রাস্তার ধারের লোকটি আলোর গতি পর্যবেক্ষণের দৃশ্য যখন নিজ চোখে দেখবে, সে এই ঘটনা আলোর গতিতেই দেখবে। আলো যথারীতি নিজ গতিতেই লোকটির চোখে প্রতিফলন সৃষ্টি করবে। কেন এমনটি হবে?
মনে করুন, একটি বাইকের সর্বোচ্চ গতি ১২০ km/h। এখন বাইক চালানোর সময় আপনি যদি এই গতিতে পৌঁছে যান, তারপর যদি আরো গতি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন তাহলে কী হবে? বৃদ্ধি পাবে গতি? এই গতিতে চলমান বাইককে যদি কেউ খুব জোরে ধাক্কাও দেয় তারপরও কী বৃদ্ধি পাবে বাইকের গতি? সাইকেল চালানোর সময় বিষয়টি আরো বেশি স্পষ্ট হয়। একটি নির্দিষ্ট গতির পর আর জোরে চালানো যায় না। তারপরও শক্তি প্রয়োগ করলে তা অপচয় হয়। আলোর ক্ষেত্রেও এই ধারণাটিই গ্রহণযোগ্য। ম্যাক্সওয়েলের থিওরি অনুসারে, আলো তাড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ আকারে চলে। এবং এর গতি সর্বোচ্চ ৩,০০,০০০ km/s। যদিও এখন পর্যন্ত এমন কোন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি যা দ্বারা আলোর গতির চেয়ে বেশি তো দূরে থাক, আলোর গতির সমান কিংবা তিন ভাগের এক ভাগ গতি অর্জন করাও সম্ভব হয়নি। তারপরও ধরে নিই, এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করা গেল যা দ্বারা বস্তুর গতি আলোর গতির খুবই কাছাকাছি করা গেল; তখন গতি সৃষ্টিকারী ওই বস্তুর ভর অসীম হয়ে যাবে! যা কার্যত অসম্ভব। সুতরাং, যে কোনো ফ্রেম অফ রেফারেন্সেই আলোর বেগ সর্বোচ্চ ৩,০০,০০০ km/s হতে পারে। এটিই স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ২য় স্বীকার্য।
এবার দৃষ্টিপাত করা যাক স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’র মূল আলোচ্য বিষয়ে। এটি মূলত তিনটি বিষয় প্রকাশ করে। দৈর্ঘ্য সংকোচন, ভর বৃদ্ধি, এবং সময় দীর্ঘায়ন।
দৈর্ঘ্য সংকোচনঃ অন্ধকার ঘরে টর্চলাইটের আলো জ্বালিয়ে সেই আলোর সামনে হাত রাখলে হাতের ছায়া কত বৃহৎ আকার ধারণ করে! কিংবা পড়ন্ত বিকেলে আমাদের ছায়া বৃহৎ আকার ধারণ করে। এটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। কেন এমনটি হয়? এর কারণ হলো আলো উৎসমুখ থেকে ঘনকোণে নিঃসরিত হয়। ঘনকোণ আবার কী!
মনে করুন, আপনি একটি নারিকেল গাছ থেকে ৫০ ফুট দূরে অবস্থান করছেন। নারিকেল গাছের মাথায় একটি দড়ি বেঁধে মাটিতে আপনার অবস্থানে নিয়ে এলেন। আর একটি দড়ি নারিকেল গাছের গোড়ায় বেঁধে অপর প্রান্ত আপনার অবস্থানে নিয়ে এলেন অর্থাৎ ৫০ ফুট দূরে। দুইটি দড়ির প্রান্ত জোড়া দিলে মাঝে ফাঁকার পরিমাণ অর্থাৎ কৌণিক পার্থক্য বা কোণের পরিমাণ পাওয়া যাবে। এখন আপনি যদি উভয় দড়ি একইভাবে বাঁধা অবস্থায় অপর প্রান্তদ্বয় ধরে ১০০ ফুট দূরে নিয়ে যান তাহলে এদের মাঝে একটি কৌণিক পার্থক্য বা কোণ পাওয়া যাবে। সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে যে, পার্থক্য ভিন্ন হবে। ৫০ ফুটের তুলনায় ১০০ ফিট দূরত্বে কোণের মান কম হবে।
এখন চিন্তা করুন তো, ১০০ ফিট দূরে গেলে নারিকেল গাছকে একটু ছোট বলে মনে হবে না? ঠিক ধরেছেন। কোণের মান যেহেতু ১০০ ফিট দূরে কম, সেহেতু সেখানে বস্তুকে ছোট দেখাবে। এই কোণই হলো ঘনকোণ। অর্থাৎ বলা যায় কোণ বস্তু কর্তৃক পর্যবেক্ষকের চোখে উৎপন্ন কোণই হলো ঘনকোণ বা ত্রিমাত্রিক কোণ। এর মানের কম-বেশি হলে একই বস্তু কখনো বড় দেখাবে, কখনো ছোট দেখাবে। এখন বলুন তো, প্রকৃতির অনেক ঘটনাই আপনার কাছে স্পষ্ট লাগছে না? আকাশে প্লেন কেন ছোট দেখায় – এর উত্তর আপনি এখন নিজেই বলতে পারবেন। আপনি কি জানেন, আপনি দৈর্ঘ্য সংকোচন বিষয়টি জেনে গেছেন? হ্যাঁ, এই যে ঘনকোণের জন্য আপাতদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষকের কাছে বস্তুর দৈর্ঘ্য কম বেশি হওয়া, এটাই দৈর্ঘ্য সংকোচন।
প্লেনের উদাহরণে, আপনি যদি মাটি থেকে না দেখে প্লেনের মধ্যে অবস্থান করেন তাহলে আপনার কাছে প্লেনটি কিন্তু বড়ই দেখাবে। অর্থাৎ দৈর্ঘ্য বিষয়টি পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ, কোথায় থেকে তিনি দেখছেন। এই বিষয়টিই ঘটে মহাকাশে বস্তু পর্যবেক্ষণের সময়।
ভর বৃদ্ধিঃ স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ২য় স্বীকার্য আলোকপাতের সময় আমরা দেখেছিলাম- আলোর কাছাকাছি গতি সৃষ্টি করার মত প্রযুক্তি যদি আবিষ্কার করা সম্ভব হয় তাহলে বস্তুর গতি আলোর গতির সমান করার পর আরো শক্তি প্রয়োগ করলেও বৃদ্ধি পাবে না গতি। তখন অতিরিক্ত শক্তির কী হবে? সেটা ভরে পরিণত হয়ে অসীম হবে। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা আলোর গতির চেয়ে অনেকগুণ কম গতির বস্তুতেই সংঘটিত হবে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন- অতিরিক্ত শক্তি ভর হিসেবে জমা হচ্ছে! তাহলে, শক্তি আর ভরের মেলবন্ধনের সাথে তৃতীয় আরেকটি বিষয় কিন্তু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর সেটা হলো আলোর গতি। তাহলে আমরা পেলাম শক্তি, ভর এবং আলোর গতির মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কেরই গাণিতিক রুপ E=mc2, এই সূত্র ব্যবহার করেই আমরা পারমাণবিক প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য শক্তি পেয়ে থাকি।
সময় দীর্ঘায়নঃ এই বিষয়কে নিয়েই একটি মজার ঘটনা প্রচলিত আছে। সেটি হল টুইন প্যারাডক্স। একই সাথে জন্ম নেয়া দুইটি শিশুর একজন পৃথিবীতে থাকলো, এবং অপরজনকে প্রায় আলোর বেগে চলমান মহাকাশযানে করে মহাকাশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। পৃথিবীতে থাকা শিশুটির বয়স যখন ৫০ বছর পূর্ণ হলো তখন অপর শিশু মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে এলো। এবার বলুন তো, মহকাশে থাকা শিশুটির বয়স কত হবে? ৫০ এর কম? অবশ্যই, ধারণা করা হয় তখন শিশুটির বয়স হবে ২/৩ বছর! এটাই সময় দীর্ঘায়ন।
গতিশীল বস্তু যে ধীরে চলে তার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় স্যাটেলাইটের ঘড়ি থেকে। স্যাটেলাইট যেহেতু চলমান তাই এর ঘড়ি ধীরে চলবে। এজন্য আমাদের পৃথিবীর ঘড়ির সাথে সামঞ্জস্য করার জন্য স্যাটেলাইটের ঘড়িতে বিশেষ এলগরিদম ব্যবহার করে সময়ের সঠিক হিসাব করা হয়। সুতরাং, সময় আপেক্ষিক।
এখানে একটি সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন চলে আসে। বিজ্ঞানী নিউটনের গতি সংক্রান্ত প্রথম সূত্র থেকে আমরা জানি, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে আকর্ষণ করে, যা মহাকর্ষ বল নামে পরিচিত। এখন কল্পনা করুন যে, হঠাৎ সূর্য হারিয়ে গেলো বা নিভে গেলো। যেহেতু সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় ৮ মিনিট সময় লাগে, সেহেতু আমরা ৮ মিনিট পর বুঝতে পারবো যে সূর্যের আলো আর নেই, মানে সূর্য হারিয়ে গেছে। কিন্তু সূর্য হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তো মহাকর্ষ বল হারিয়ে যাবে, কারণ বস্তু না থাকলে মহাকর্ষ বল কীভাবে থাকবে? তাই নয় কি? তাহলে সূর্যের হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমরা বুঝে যাব সূর্যের মহাকর্ষ বল নেই। সমস্যাটা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছেন। সাথে সাথেই আমরা বুঝে যাব মহাকর্ষ বল নেই, কিন্তু ৮ মিনিট পর আমরা বুঝতে পারব যে আলো নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাহলে মহাকর্ষ বলের গতি আলোর চেয়ে বেশি! মহাকর্ষ বল, গতি বিবেচনায় ছাড়িয়ে গেল আলোকে?
এই সমস্যার সমাধানে আলবার্ট আইনস্টাইনের আরো ১০ বছর সময় লাগল। ১৯১৫ সালে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ দিয়ে আবিষ্কার করলেন জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি।
জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বোঝার আগে একটি বিষয় কল্পনা করুন। আপনি একটি ছোট পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর চড়তে শুরু করলেন পাহাড়ে। ঘড়িতে দেখলেন ২০ মিনিট পর আপনি পাহাড়ের চূড়ায় চলে এসেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় এসে আপনার অবস্থানের কী কী পরিবর্তন হলো? উচ্চতার পরিবর্তন হয়েছে। শুধু কি উচ্চতা, নাকি দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাত্রারও পরিবর্তন হয়েছে? হ্যাঁ, তিনটিরই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি শুধু এই তিনটি বিষয়েরই পরিবর্তন হয়েছে? আপনার হাতে থাকা ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা ২০ বার ঘুরেছে। অর্থাৎ, ২০ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। তাহলে আপনার সম্পূর্ণ অবস্থানের পরিবর্তন বুঝতে হলে আপনাকে চারটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হচ্ছে। চতুর্থ মাত্রা হিসেবে যোগ হচ্ছে সময়। সুতরাং মহাজগৎ চতুর্মাত্রিক। এই চারটি মাত্রাকে একত্রে বলা হয় স্থান-কাল বা স্পেসটাইম।
এবার আর একটি বিষয় কল্পনা করুন। একটি কাপড়কে চার কোণায় বেঁধে কাপড়ের মাঝখানে একটি ভারী বস্তু রেখে দিলেন। ওই কাপড়ের মাঝখানে একটু নিচে নেমে যাবে। এখন একটি ছোট বল কাপড়ের ওপর ছেড়ে দিলে তা বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকবে এবং কিছুক্ষণ পর তা ভারী বস্তুর ওপর গিয়ে পরবে। তদ্রুপ, মহাকাশের কোনো বস্তুর অবস্থানের কারণে তার স্থান-কাল বেঁকে যায়। একে স্থান-কাল বক্রতা বা spacetime curvature বলে।
এই স্থান-কাল বক্রতার কী কী প্রভাব হতে পারে? স্পেশাল থিওরিতে আমরা জেনেছি সময় দীর্ঘায়ন সম্পর্কে। কিন্তু কেন হয় এই সময় দীর্ঘায়ন, তার উত্তর পাওয়া যায়নি তখন। পরে জানা গেল, এটা স্থান-কাল বক্রতার প্রভাব। অর্থাৎ মহাবিশ্বের কোনো বস্তু তার বিশাল ভর ও অবস্থানের জন্য সময়কেও বাঁকিয়ে দিতে পারে, আর এজন্যেই সময় দীর্ঘায়ন ঘটে। আবার ওই ভারী বস্তুটি স্থানকেও বাঁকিয়ে দেয়। এই বাঁকিয়ে দেয়ার পরিমাণ পরিমাণ কখনো কখনো এতটাই শক্তিশালী হয় যে তা থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না। (ধরুন, চার কোণায় বাঁধা কাপড়টির মাঝখানে একটি বিশাল ভারী বস্তু রাখা হয়েছে। এতই ভারী যে এখন তার আশে পাশে কিছু ঘুরতে পারবে না। বল রাখলে সরাসরি বস্তুটির অপর গিয়ে পরবে)। মহাকাশের শক্তিশালী এই স্থান-কাল বক্রতার নাম কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। স্থান-কাল বক্রতার জন্য কৃষ্ণগহ্বর থেকে আলোও বের হতে পারে না। এই বিষয়ে আরো পড়তে পারেন, বিজ্ঞানযাত্রার প্রবন্ধ মহাকর্ষীয় তরঙ্গঃ সহজ ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞান থেকে।
এখন তাহলে সৌরজগতের কথায় আসি। সূর্যের অবস্থানের কারণে চারিদিকে বেঁকে গেছে, এই স্থান-কাল বক্রতার ফলেই পৃথিবীর গতি হয়েছে বৃত্তাকার পথ। অতীতে যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবীকে সূর্যের স্থান-কাল বক্রতার মধ্যে নিয়ে এসেছে সেই শক্তিই এখনো কাজ করছে। এখানে ব্যবহৃত কাপড়ের উদাহরণটিতে বলটি কাপড়ের পৃষ্ঠে ঘর্ষণ ক্রিয়া করবে, ফলে তা শক্তি হারিয়ে ভারী বস্তুতে পতিত হবে। কিন্তু পৃথিবীর ক্ষেত্রে এরুপ ঘর্ষণের সুযোগ নেই, তাই পৃথিবী অবিরাম ঘুরছে। সুতরাং, নিউটনীয় বলবিদ্যা অনুসারে আমরা যে মহাকর্ষ বলের কথা বলি তা আসলে কোনো বল নয়, থিওরি অফ রিলেটিভিটি অনুসারে তা স্থান-কাল বক্রতার প্রভাব।
আমরা জানি আলো সরলপথে চলে। কিন্তু স্থান-কাল বক্রতার ফলে তা মহাকাশীয় বস্তুর কাছে গেলে কিছুটা বেঁকে যায়। ফলে আমরা যে অবস্থানে কোনো নক্ষত্র বা গ্রহ দেখি, তা আসলে সেই অবস্থানে নেই। এবং এটা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত। আলোর এই বেঁকে যাওয়াকে বলে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং। এই স্থান-কাল বক্রতা দিয়েই মহাজাগতিক এরুপ বহু ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয় – এটাই জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি।
থিওরি অফ রিলেটিভিটি শুধুমাত্র কোনো ধারণা নয়। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন আমরা তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করি। এর গাণিতিক প্রমাণের জন্য উচ্চতর গণিতের সাহায্যে অনেক জটিল হিসাব করতে হয়, যা সহজে বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। তবে শুধুমাত্র তত্ত্বীয় বিষয়টি নখদর্পণে থাকলে গাণিতিক হিসাব বোঝাও সহজ হয়ে যায়। থিওরি অফ রিলেটিভিটি আমাদের জ্ঞানচক্ষুকে উদ্ভাসিত করে, প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহ বৃদ্ধি করে। প্রকৃতির ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করার মাধ্যম সৃষ্টি করে। কে জানে, হয়ত এভাবেই পদার্থবিজ্ঞানের অব্যাহত সৃষ্টিশীলতা আমাদের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে আরো গভীর জ্ঞান দান করবে- হয়ত থিওরি অফ রিলেটিভিটিই ছিল এর সূচনালগ্ন!