২০১৬ এর ১৮ অগাষ্ট, আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যে ৭০ বছর বয়স্ক একজন ভদ্রমহিলা প্রচণ্ড জ্বর আর ডান নিতম্বে ঘা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন আগে তিনি তার কয়েক বছর দীর্ঘ ভারত সফর শেষে দেশে ফিরেছিলেন। ভারতেও তিনি তার ডান পা ভাঙ্গার কারণে কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমেরিকার চিকিৎসক তার ইনফেকশনের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে তাকে এ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। কিন্তু তিনি ভালো হলেন না। পরে তাকে অন্য আরও একটি এ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হলো, আর এটিও কোন কাজ করল না। এভাবে চিকিৎসক তাকে একে একে ১৪ প্রকার এ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। কিন্তু কোন লাভই হলো না তাতে। ১৫তম এ্যান্টিবায়োটিকটি যাচাই করার সুযোগ না দিয়ে বৃদ্ধা মারা গেলেন। যদিও তার মৃত্যুর পর এই পরীক্ষা নিরীক্ষা থেমে থাকেনি। ল্যাব টেস্টে দেখা যায়, আমেরিকাতে প্রাপ্ত ২৬টি এ্যান্টিবায়োটিকের একটি দিয়েও ঐ বৃদ্ধার রক্তে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
এমন ঘটনা নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ববাসীকে বারবার দেখতে হবে বলে আশংকা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই ব্যাকটেরিয়াটি ছিলো আসলে একটি সুপারবাগ। সুপারবাগ হল ব্যাকটেরিয়ার সেই স্ট্রেইন, যারা একাধিক এ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যাান্ট। যার অর্থ হচ্ছে, ঐ বিশেষ এন্টিবায়োটিকগুলো দিয়ে রোগসৃষ্টিকারী ঐ ব্যাকটেরিয়াটিকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এই বিষয়টিকে বলে এ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স। এ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স তখনই ঘটে যখন ব্যাকটেরিয়ার কোষে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে, যার দরুন ব্যবহৃত এ্যান্টিবায়োটিকটির কার্যকারিতা পূর্বের মত থাকে না অথবা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে ঐ ব্যাকটেরিয়াটি পূর্বের থেকেও বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠে।
প্রতিবছর ২ লাখ ৩০ হাজার নবজাতক এ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর কারণে মারা যায়। আফ্রিকাতে গত ৩-৪ বছর আগে টাইফয়েডের একটি নতুন স্ট্রেইনের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে যা প্রতিরোধযোগ্য নয়। এছাড়া সেখানে এইডস এর চিকিৎসাও অকেজো হয়ে পড়েছে। ১০৫টি দেশে টিউবারকিউলোসিসের নতুন স্ট্রেইন আত্মপ্রকাশ করেছে, যাতে এ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২২টি দেশে পরিচালিত জরিপ থেকে ৫ লাখ মানুষের মধ্যে এমন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছে, যা এক বা একাধিক এ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট। এদের মধ্যে নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ক্লেবসিলা নিউমোনিয়া, ইউরিনারী ট্র্যাকের ইনফেকশন সহ অন্যান্য ইনফেকশন, যেমন- ব্যাকটেরেমিয়া সৃষ্টিকারী ‘এশেরিকিয়া কোলাই’, হাড়ের ইনফেকশন সৃষ্টিকারী ‘স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস’, খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী ‘সালমোনেলা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া যক্ষা সৃষ্টিকারী ‘টিউবারকিউলোসিস’ তো আছেই। আর ভয়ের বিষয় হচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই এই সুপারবাগগুলো হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছে গেছে।
আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যা আপাদমস্তক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমরা যেখানে যাই না কেন (খুব গরম বা খুব শীত প্রধান স্থান), যা কিছু খাই না কেন, যা কিছু পরিধান করি না কেন, যা কিছু স্পর্শ করি না কেন, সবকিছুই ব্যাকটেরিয়া বেষ্টিত । কিন্তু এরা এত ক্ষুদ্র যে, অনুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া আমরা এদের দেখতে পাই না। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সর্বত্র বসবাসকারী এই অনুজীবটি যখনই অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিবেশ পায়, তখনই দ্রুতহারে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। মানবদেহ ব্যাকটেরিয়ার এমনই একটি অনুকূল আবাসস্থল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ও বলা হত যে, মানুষের শরীরে মানুষের কোষ অপেক্ষা ব্যাকটেরিয়ার কোষ ১০ গুন বেশী। তবে অতি সম্প্রতি ইসরাইল ভিত্তিক একটি গবেষণা বলছে, আসলে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষের এবং ব্যাকটেরিয়ার কোষ থাকে মানুষের শরীরে। বিষয়টি এমন যে, আমরা যতটুকু মানুষ – ঠিক ততটুকু আবার এককোষী জীব ব্যাকটেরিয়া। যদিও এত সরলভাবে কোনো কিছু বলা যায় না। তবে এ যাবত যা জানা সম্ভব হয়েছে, তার আলোকে বলা যায়, কিছু ব্যকটেরিয়া মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি অত্যাবশ্যকীয়। আর মানুষের শরীরের বেশির ভাগ ব্যাকটেরিয়ার বাস মানুষের বৃহদান্ত্রে। এরা খাবার হজমে, পুষ্টি শোষণে, কিছু ভিটামিন (ভিটামিন -বি) সংশ্লেষণে সহায়তাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবানুকে প্রতিরোধ করে। তবে উল্টোটাও আছে। এদের অনেকে বিভিন্ন প্রকার রোগ সৃষ্টি করে। যেমন-নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত রোগের চিকিৎসায় এখনকার মত এ্যান্টিবায়োটিক না থাকার কারণে মানুষকে অভাবনীয় ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, দিতে হয়েছে অসংখ্য প্রাণ। সেসময় শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ছিল একমাত্র ভরসা। তবে প্রায়ই এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরাজিত হতো এই ক্ষুদ্র জীবটির কাছে। যেমন- সেসময় ব্যাকটেরিয়া ঘটিত মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত ৯০ ভাগ শিশুই মারা যেতো, আর যারা বেঁচে থাকতো, তারাও হয় বধির নয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতো। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সামান্য গলাব্যাথাও ছিল মারাত্মক রোগ। কানের ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ত মস্তিষ্কে। আর যক্ষা, নিউমোনিয়া, হুপিং কাশি এসবে মৃত্যু না হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক। আজকের পৃথিবীতে এসব সংক্রমণ মোকবেলার জন্য আমাদের হাতে আছে এ্যান্টিবায়োটিক। তবে খোদ এ্যান্টিবায়োটিকের জনক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর সতর্কবাণী আজ বাস্তব সমস্যা হয়ে আমাদের সামনে উপনীত। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পাবার পর নিউ ইয়র্ক টাইমস কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন যে, এ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার এ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। তার কথাকে সত্য প্রমাণিত করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একটির পর একটি এ্যান্টিবায়োটিক এসব ব্যাকটেরিয়ার উপর অকার্যকর হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়াগুলো এদের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, একজন মানুষ কোনো এন্টিবায়োটিক এর প্রতি রেজিসট্যান্ট হয়ে যায়। আসলে ব্যক্তি নয়, ব্যাকটেরিয়া রেজিসটেন্ট হয়ে যায় কোন বিশেষ এন্টিবায়োটিক এর প্রতি। যার কারণে ঐ এন্টিবায়োটিকটি দিয়ে বিশেষ রেজিসটেন্ট ব্যাকটেরিয়াকে আর ধ্বংস করা সম্ভব হয়না।
উৎপত্তির সূত্র ধরে এ্যান্টিবায়োটিক শব্দটি দ্বারা ছত্রাক বা অন্যকোন অনুজীব হতে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত উপাদানকে বোঝায়, যা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। এসব ছত্রাক বা অনুজীব সাধারনত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ মোকাবেলা করতেই বিভিন্ন এ্যান্টিবায়োটিক উপাদান তৈরী করে। প্রাকৃতিক এ্যান্টিবায়োটিকের আদলে ল্যাবে কৃত্রিক এ্যান্টিবায়োটিক তৈরী করেও ব্যবহার করা হয়। বিগত ৬০ বছর ধরে এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের কারণে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সেইসব স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে যা একসময় কঠিন বা অসম্ভব ছিল। আলেকজান্ডার ১৯২৭ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন এবং প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৪০ সালে। এরপর থেকে নাটকীয়ভাবে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এবং এসব রোগ থেকে মৃত্যুহার কমতে থাকে। আজকে যে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, তাতে এ্যান্টিবায়োটিক এর অনেক বড় অবদান রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এ্যান্টিবায়োটিক এর কল্যাণে ১০ বছর গড় আয়ু বেড়েছে মানুষের! তবে, বিগত কয়েক বছর যাবত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে এন্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হয়ে পড়ার খবর শোনা যাচ্ছিলো। আর বর্তমানে এই পরিস্থিতি এতটাই প্রকট যে, বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পৃথিবী কার্যকর এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ শূন্য হয়ে যাবে, যদি না নতুন কোন ড্রাগ ডিজাইন করা হয়। বর্তমানে ব্যবহৃত সবগুলো এ্যান্টিবায়োটিকই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। একটি ড্রাগ যদি আমেরিকায় কোন ব্যাকটেরিয়ার প্রতি অকার্যকর হয়, অপরটি বাংলাদেশে কোন ব্যাকটেরিয়ার প্রতি অকার্যকর হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিটি এ্যান্টিবায়োটিক এর বিপরীতেই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার ক্রমবিকাশ ঘটছে। আর এক জায়গায় ক্রমবিকশিত হওয়া রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। কেননা ব্যাকটেরিয়া মানুষের মত বর্ডার আইন মেনে চলাফেরা করে না। তাই, একসময় যেসব রোগ সহজেই চিকিৎসা করা যেত, এখন তা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এদের মধ্যে আছে নিউমোনিয়া, যক্ষা, রক্তে সংক্রমন, গনোরিয়া, খাদ্যে বিষক্রিয়া ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়। এর ফলে পৃথিবীর সকল অস্ত্রপোচার, সিজারিয়ান সেকশন, ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, হাড়সন্ধি প্রতিস্থাপন এবং আরো অনেক চিকিৎসা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আর অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে একসময় এসব চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়াও অসম্ভব না।
কীভাবে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে হলে আমাদের এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ গুলো কীভাবে কাজ করে তা জানতে হবে। এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগগুলো খুব চতুরতার সাথে ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমন করে। ব্যাকটেরিয়াতে এমন অনেক জৈব-রাসায়নিক পদার্থ আছে যা মানুষের শরীরে নেই। এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগগুলোকে গবেষণাগারে এমনভাবে তৈরী করা হয়, যাতে এগুলো ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের বিশেষ কিছু জৈব-রাসায়নিক পদার্থকে চিনতে পারে, যা মানুষের কোষঝিল্লির বাহিরে নেই। এরপর এটি ঐ জৈব-রাসায়নিক পদার্থ এর সাথে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে এবং কোষকে ধ্বংস করে। মানুষের কোষের বাহিরে ঐ বিশেষ জৈব-রাসায়নিক পদার্থ না থাকায় এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ মানুষের কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া একটি জীবিত সত্ত্বা, তাই এ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রানপণ লড়ে যাবে এটিই স্বাভাবিক। আর এ স্বাভাবিক কাজটি করতে গিয়ে জন্ম হবে এ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্ট ব্যাকটেরিয়ার। তিনভাবে ব্যাকটেরিয়া এ্যান্টিবায়োটিককে প্রতিরোধ করে অর্থাৎ এ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিসট্যান্ট হয়ে উঠে।
১) এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ কে বাধা প্রদান করা যাতে সে ব্যাকটেরিয়া কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। এর জন্য কখনও কখনও এরা কোষে প্রবেশের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়। কখনও আবার ঢুকে পড়া ড্রাগগুলো দ্বারা ক্ষতি সংঘটিত হবার আগেই কোষের বাহিরে এদের ছুঁড়ে মারে।
২) কখনও আবার এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। অর্থাৎ, যে ক্যামিকেলগুলো দেখে এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ ব্যাকটেরিয়ার কোষকে চিনতে পারে, সে ক্যামিকেল গুলোকে পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে পাশাপাশি অবস্থান করেও ড্রাগ এদের ভেতরে প্রবেশ করে না। কারণ যাদের মাধ্যমে তারা কোষে প্রবেশ করবে তাদের এরা পায় না।
৩) তৃতীয় উপায় হলো এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগকে ধ্বংস করা। এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া এমন কিছু ক্যামিকেল ছুঁড়তে থাকে যে ড্রাগটি ব্যাকটেরিয়া কোষের সংস্পর্শে আসার আগেই মিসাইলের মত ক্যামিকেলগুলো ড্রাগগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
এখন এই ড্রাগ গুলোকে মোকাবেলা করার জন্য নতুন বায়োক্যামিকেল উৎপাদন বা বিদ্যমান ক্যামিকেলের পরিবর্তন যাই করুক না কেন তার জন্য ব্যাকটেরিয়ার কোষে কিছু জিন থাকা প্রয়োজন। জিন হচ্ছে কোন একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য দায়ী ডিএনএ অণু। এই যে আমরা কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ গাঢ় বর্ণের, কেউবা হালকা বর্ণের, এসব আসলে ভিন্ন ভিন্ন জিনের জন্য হয়। ব্যাকটেরিয়ারও আছে এমন হাজারো জিন । যে ব্যাকটেরিয়াটি ৩৪০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে তার শরীরে এমন কোন জিন আছে যা তাকে তাপ সহিষ্ণু করেছে, আবার যে ব্যাকটেরিয়াটি -২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে তার শরীরে এমন কোন জিন আছে যা তাকে ঠাণ্ডা সহিষ্ণু করেছে। ঠিক একইভাবে যে ব্যাকটেরিয়াটি এন্টিবায়োটিক ড্রাগের উপস্থিতিতেও বহাল তবিয়তে থাকতে পারে, তার শরীরেও এমন কোন জিন আছে যা তাকে ঐ এন্টিবায়োটিক কে প্রতিরোধ করে বেঁচে থাকবার সক্ষমতা দিয়েছে। যে ব্যাকটেরিয়ার কোষে এ্যান্টিবায়োটিক সহিষ্ণু জিন নেই, সে সংবেদনশীল। অর্থাৎ এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে সে মারা যাবে। আর যে ব্যাকটেরিয়ার কোষে এ্যান্টিবায়োটিক সহিষ্ণু জিন আছে, সে এ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অর্থাৎ এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেও সে বেঁচে থাকবে। এখন, প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে এ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল একটি ব্যাকটেরিয়া রূপান্তরিত হয় এ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী একটি ব্যাকটেরিয়ায়। তার কোষে তো এ্যান্টিবায়োটিক সহিষ্ণু জিন ছিলো না। তাহলে এই জিন সে কিভাবে এবং কোথায় থেকে পেলো?
ব্যাকটেরিয়ার বিস্ময়কর জিন আদান-প্রদানের বৈশিষ্ট্য থেকে এর উত্তর পাওয়া যায়। আমরা মানুষ আমাদের যাবতীয় জিনের অর্ধেক মা আর বাকী অর্ধেক বাবা হতে পাই এবং আর কোথাও থেকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া তার আদি কোষ ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে জিন পেতে পারে। অর্থাৎ, একটি ব্যাকটেরিয়া তার টিকে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় জিন নিজের শরীরে খুঁজে না পেলে অন্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করে নেবে। যেমন-
১) ব্যাকটেরিয়া অপর একটি মৃত ব্যাকটেরিয়া থেকে একটি জিন নিজের শরীরে নিয়ে নিতে পারে। বিষয়টি ড. কার্ল ক্লোজ বেশ মজা করে বলেছেন যে, একজন লম্বাদেহের মৃত মানুষের এক টুকরো মাংস চিবিয়ে খেয়ে একজন জীবিত খাটো মানুষ লম্বা হয়ে যেতে পারত যদি এই বৈশিষ্ট্যটি মানুষের থাকত।
২) আবার, ব্যাকটেরিয়া যখন ফ্লু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন ব্যাকটেরিয়ার জিন ফ্লু ভাইরাসের মধ্যে ঢুকে যায়। এই ফ্লু ভাইরাসটি যখন অপর কোনো ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমন করে, তখন সেই জিনটি ঐ ব্যাকটেরিয়াতে চলে যেতে পারে। এই বিষয়টি এমন যে, এই বৈশিষ্ট্যটি মানুষের থাকলে একটি লম্বা মানুষের শরীর থেকে কিছু ফ্লু ভাইরাস নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে গ্রহণ করে মানুষ ফ্লু আক্রান্ত হতো এবং লম্বা হয়ে যেতো।
৩) এছাড়া, ব্যাকটেরিয়া অন্য ব্যাকটেরিয়ার সাথে একটি কৃত্রিম সেতু তৈরী করে জিন আদান প্রদান করে। একে ব্যাকটেরিয়ার যৌন মিলন বলে। এরূপ যৌন মিলন মানুষে সম্ভব হলে লম্বা একজন মানুষের সাথে যৌন সঙ্গম করে একজন খাটো মানুষ দিন শেষে লম্বা হয়ে যেতো।
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ব্যাকটেরিয়া এ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় জিন অন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে পেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অন্য ব্যাকটেরিয়াতেই বা সেই বিশেষ জিন কোথায় থেকে আসলো? ব্যাকটেরিয়ার কোষে বিভিন্ন কারণে এলোমেলোভাবে মিউটেশন ঘটে, অর্থাৎ ডি এন এ অনুর পরিবর্তন হয় এবং নতুন জিন সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এই পরিবর্তিত জিন ব্যাকটেরিয়া কোষের জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনে, যেমন-এ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্স ক্ষমতা দেয়। খোদ, মানুষের শরীরেই ১০ হাজারের বেশি ধরণের ব্যাকটেরিয়া আছে। বাহিরের পরিবেশের কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ১০ হাজার প্রকার ব্যাকটেরিয়ার কারো না কারো কোষে পেনিসিলিনকে প্রতিরোধ করবার জন্য প্রয়োজনীয় জিন থাকতেই পারে, আর তা অন্য ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর হতেই পারে। অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবেই এ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার এই প্রক্রিয়াতে আরো বেশি হাওয়া দেয়। এ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ৯৯.৯% ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংশ করা সম্ভব হলেও ন্যাচরাল সিলেকশনের কারণে ভগ্নাংশ সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া বেঁচে যায়। এরাই পরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ট হয় এবং এদের কাছে এ্যান্টিবায়োটিক অকেজো হয়ে পড়ে। কখনও কখনও এমনো হয় যে, একটি নিরীহ ব্যাকটেরিয়াতে একটি পেনিসিলিন প্রতিরোধী জিন আছে, আর তাতে ক্ষতির কোন কারণ ঘটে না। কিন্তু এই জিনটি যখন একটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর হয়ে একে পেনিসিলিন প্রতিরোধী করে দেয়, তখনই সর্বনাশটা হয়। সঠিক নিয়মে এ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করার কারণেও রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধে অসমর্থ হয়। এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মেরামতে সময় দেয়। তাই ততক্ষণ এ্যান্টিবায়োটিক কাজ করা জরুরী, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়।
আসুন একটি দৃশ্য কল্পনা করি। আমরা ছোট বেলায় শুনতাম দুষ্ট লোক দমন করতে কিছু বিশিষ্ট লোক লাঠি চালিয়ে দিতে পারেন, যে লাঠিটি নিজে নিজে চলে গিয়ে সেই দুষ্টু লোকের পিঠে চড়াও হবে। সাধারনত চোর ধরতেই নাকি এমন কাজ করা হতো। সে যাই হোক, আজ আমরা দুষ্টু ব্যাকটেরিয়া মারতে এমন লাঠির সাহায্য নিবো। মনে করুন, আপনার পাকস্থলীতে খাদ্যের সাথে ৫টি কালো বর্ণের দুষ্টু ব্যাকটেরিয়া ঢুকে গেল। এই ব্যাকটেরিয়া গুলো সেখানে পৌঁছা মাত্র দুষ্টুমি শুরু করে দিলো। নানা প্রকার বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করতে থাকলো। তখন পর্যন্ত সংখ্যায় কম বলে আপনি টের পেলেন না। কিন্তু এরা প্রতি ২০ সেকেন্ডে দ্বিগুণ হতে থাকলো। এভাবে ৫টি থেকে ১০টি, ১০টি থেকে ২০টি হতে হতে যখন ৮০ টি হয়ে গেলো, তখন এদের নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থে আপনার পেটে গোলযোগ শুরু হয়ে গেলো। আপনি ছুটলেন সেই বিশিষ্ট লোকের খোঁজে, যিনি লাঠি চালিয়ে দুষ্টু দমন করেন। সেই ভদ্রলোক সেলামির বিনিময়ে দিলেন লাঠি চালিয়ে আপনার পেটে। মুখে বললেন, “যারে লাঠি যা, যারে দেখবি কালা তারে মাইরা ফ্যালা”। তবে একবার চালিয়ে দেয়া লাঠি ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে বলে ৮ ঘণ্টা পর নতুন লাঠি পাঠাতে হবে। আর এভাবে তিন দিন উত্তম মধ্যম খেলে দুষ্ট ব্যাকটেরিয়ার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। এখন লাঠি ছুটল পাকস্থলীর উদ্দেশ্যে। সেখানে কালো বর্ণের শুধু ৮০টি দুষ্টু ব্যাকটেরিয়াই নেই, আছে ২০টি ভালো ব্যাকটেরিয়াও। কিন্তু লাঠি গণহারে এই ১০০টি কালো মারতে থাকে, সে হোক দুষ্টু কিংবা নিতান্ত নিরীহ বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া। লাঠি শুধু মাত্র গায়ের রংটিই চিনতে পারে। ব্যাকটেরিয়াটি উপকারী না অপকারী, তা বোঝার ক্ষমতা লাঠির নেই। ১০০টি ব্যাকটেরিয়াতো লাঠির আঘাতে ত্রাহি ত্রাহি শুরু করলো। অকস্মাৎ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ৫০ টি রোগা-পটকা ব্যাকটেরিয়া প্রথম ৮ ঘণ্টাতেই মারা গেলো। যারা একটু হৃষ্টপুষ্ট, তারা টিকে থাকল। আপনি একটু ভালো বোধ করলেন, কারণ একে তো ৫০টি মারা গেছে তার উপর বাকি ৫০টিরও নিজের জান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে বলে দুষ্টমি কিছু কমেছে। ৮ ঘন্টা পর চালিয়ে দিলেন আর একটি লাঠি। নতুন লাঠির আগমনে কালো ব্যাকটেরিয়াগুলোর বুঝতে বাকি থাকলোনা যে, এ যাত্রায় বাঁচতে হলে সবটুকু দিয়ে লড়তে হবে। তারা নিজেদের কোষে এবং বাহিরে প্রয়োজনীয় জিন খুঁজতে লাগলো, যার সাহায্যে এ লাঠিগুলো থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু ততক্ষণে আরো ২৫টি কালো ব্যাকটেরিয়া মারা গেলো। আপনি আরো একটু ভালো বোধ করলেন। বাকি ২৫টি বসলো জরুরী বৈঠকে, সিদ্ধান্ত হলো জান লাগিয়ে লড়ার। এসময় ওদের মধ্যে একটু বেঁটে মতন চকচকে মাথার একটি কালো ব্যাকটেরিয়া বললো, ”দেখুন জনাব, আমি এর আগেও আমার আগের বাসস্থানে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ওই সময় কোথা থেকে যেন শুধু লৌহ গোলক পড়ছিলো, আর মাথা বরাবর আঘাত করছিলো। কেউ কেউ মাথাকে লুকিয়ে রেখে সাময়িক বাঁচতে পারছিলো, তবে পাকাপোক্ত ভাবে না। আমি খেয়াল করলাম, পাশের বাসার রইসরা দিব্বি ভালো আছে। কারণ, ওদের সবার মাথা ছিল আয়রন দিয়ে বাঁধানো। এই এখন আমার মাথাটি যেমন, ঠিক তেমন। আমি রইসের কদাকার বোনটিকে পটিয়ে বিয়ে করতে চাইলাম, যাতে আমার মাথাও তার মতন হয়। কিন্তু সে কুৎসিত শয়তান আগেই এক বিচ্ছুকে মন দিয়ে রেখেছিলো। তাই যখন একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছি, আর মাথাতে উপুর্যপরি আঘাত পেতে পেতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি, তখন হঠাৎ করে হার্ট এ্যাটাক করে রইসের দাদা আমার জন্য সুসংবাদ এনে দিয়েছিলো। আমি মৃত বুড়োটির কোষ থেকে ধাতব মাথা তৈরীর জিন সবার অলক্ষ্যে নিজের কোষে ঢুকিয়ে নিলাম, আর মাথাটাকে এমন ধাতব করে ফেল্লাম। এভাবে আমি সেই যাত্রায় বাঁচতে সক্ষম হলাম। এখন আর কোনো গোলক আমাকে মারতে পারবে না। আপনারা চারিদিকে দেখেন, আমাদের চারপাশে সাদা ব্যাকটেরিয়া গুলো কেমন দাঁত কেলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদেরকে এই লাঠি গুলো মারছে না। আসুন ওদের সাথে যৌন সঙ্গম করি, নয়তো সাদা মৃত ব্যাকটেরিয়া থেকে সাদা চামড়ার জন্য দায়ী জিন সংগ্রহ করি। এই জিনগুলো আমাদের গায়ের রংকে সাদা করবে, আর এর ফলে ঐ নচ্ছার লাঠিগুলো আমাদের আর মারবে না। কেননা এগুলো শুধু কালোকেই মারে। সবাই এই অতি চতুর ব্যাকটেরিয়ার সাথে সহমত প্রকাশ করে কাজে নেমে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে চলে এসেছে ৩য় লাঠি। মারা গেলো আরো ১৩টি কালো ব্যাকটেরিয়া। বাকি থাকলো ১২টি। এদের মধ্যে ৫টি সাদা হওয়ার জিন সংগ্রহ করতে সমর্থ হলো। তবে এরা পুরোপুরি সাদা না হয়ে ছাই বর্ণের হলো। কারণ এদের কোষে কালো বর্ণের জন্য দায়ী জিনও আছে। ৪র্থ লাঠিটি এদেরকে আবছা দেখতে পেলো বলে এরা ঘায়েল হলেও এ যাত্রায় বেঁচে গেলো। তবে ৫ম লাঠিটি আসলে এদের আর শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হলো না। কিন্তু এই ৫টি দুষ্ট ব্যাকটেরিয়া সংখ্যায় এত কম যে আপনি একদম সুস্থ্য বোধ করলেন, আর সিদ্ধান্ত নিলেন যে আর লাঠি চালান দেবেন না বরং বাকি লাঠিগুলো রেখে দেবেন পরবর্তী সময়ের জন্য। এতে করে আপনার কিছু টাকা বাঁচবে। বেঁচে যাওয়া ৫টি ব্যাকটেরিয়া তো উৎসব শুরু করে দিলো। কারণ এখন তারা অনেক শক্তিশালী। লাঠি চালিয়ে এখন আর তাদের কাবু করা যাবে না। আর ৫টির মধ্যে ঐ বেঁটে মতন ধাতব মাথার চিকন বুদ্ধির ব্যাকটেরিয়াটিও আছে। সে তো নিজেকে সুপার বাগ বলে ঘোষণা করে দিলো। কেননা লাঠি বা ধাতব বল, কেউ-ই আর তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তার পরবর্তী প্রজন্মও সুপার বাগ হবে। সে সবাইকে আহ্বান জানাল নতুন নতুন বাসস্থান খুঁজে বের করে সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করার জন্য।
উপরোক্তভাবেই আসলে রেজিসট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া ও সুপারবাগ তৈরী হয়। লাঠি বা গোলক হলো দুই শ্রেনীর এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ। এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ব্যবহারই রেজিসট্যান্স ব্যাকটেরিয়া তৈরী করে, আর কোর্স শেষ না করার কারণে এরা বাহিরে ছড়িয়ে পড়ে। বেশি বেশি ব্যবহার এবং অকাজে ব্যবহার ব্যাকটেরিয়ার রেজিসট্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যেকবার ঔষধ বা এ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পর যারা ঐ ঔষধ বা এ্যান্টিবায়োটিক এর প্রতি রেজিসট্যান্ট নয়, তারা মারা যায়। আর যারা রেজিসট্যান্ট, তারা বেঁচে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে। এজন্য বার বার ব্যবহারের ফলে ড্রাগ রেজিসট্যান্ট ব্যকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। একটি জরীপ বলছে, আমেরিকাতে গবাদি পশুপাখিতে ব্যবহৃত এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ৭০ ভাগই ব্যবহৃত হয় সুস্থ পশুপাখিতে। জানি না, আমাদের দেশে এমন জরীপ চালালে তা কতটা ভয়াবহ ফলাফল দিত। পশুপাখিতে এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ব্যবহার প্রতিনিয়ত এ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করছে, আর তা মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে। শুধু পশুপাখি নয়, মানুষও অপ্রয়োজনে অনেক সময় এ্যান্টিবায়োটি ড্রাগ ব্যবহার করে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত এবং টার্কির মত ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ্যান্টিবায়োটি ড্রাগের ব্যবহার অভাবনীয় ভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ, ভারতে লোকজন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এ্যান্টিবায়োটি ড্রাগ ক্রয় করতে পারে। চীনে প্রেসক্রিপশনে এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ লেখার কারণে ড্রাগ কোম্পানি ডাক্তারকে পুরষ্কৃত করেন। যেসব ছোটখাটো সংক্রমণে এ্যান্টিবায়োটিক না খেলেও চলে, সেক্ষেত্রেও মানুষ এ্যান্টিবায়োটিক লিখতে চিকিৎসককে প্ররোচিত করে। এছাড়া প্রায়ই ভাইরাল সংক্রমনণেও এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ব্যবহার হয়, যখন কি না ভাইরাসের জন্য এই এ্যান্টিবায়োটিকগুলো মোটেই কার্যকরী নয়। ভাইরাসের গঠন এবং বংশবৃদ্ধির ধরণটাই ভিন্ন বলে “এক ঢিলে দুই পাখি” তত্ত্ব এখানে কাজ করে না। ভাইরাসের জন্য ব্যবহৃত ড্রাগকে এন্টিভাইরাল ড্রাগ বলে। এইচ.আই.ভি. ভাইরাস ছাড়া বেশির ভাগ ভাইরাসকে শরীর নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে ভাইরাল সংক্রমণের সময় যখন যুগপৎ ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের ঘটনা ঘটে বা সম্ভাবনা থাকে, তখন চিকিৎসক এ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। এছাড়া অন্যান্য যে বিষয়গুলোর কারণে এ্যান্টিবায়োটিক বেশী ব্যবহার করতে হয়, তাদের মধ্যে শহরগুলোতে ঘনবাস, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং দূষিত পানি পান উল্লেখযোগ্য।
এতদিন যেভাবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাতে পরিবর্তন আনাটা এখন সময়ের দাবী। পরিস্থিতিকে শুধরে না নিলে আমাদের আবার এন্টিবায়োটিক আসার আগের সময়ে ফিরে যেতে হবে, যখন সামান্য দাঁত পড়া থেকেও কারো মৃত্যু হতে পারে। নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরী করা হলেও আচরণ পরিবর্তন না করলে এসব নতুন এন্টিবায়োটিক এর প্রতি ব্যাকটেরিয়াগুলো রেজিস্ট্যান্ট হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আর আচরণ পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে টিকা কর্মসূচী, পরিষ্কার-পরিছন্নতা, নিরাপদ যৈানমিলন এবং জীবাণুমুক্ত খাবার গ্রহণের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রতিরোধঃ
১. ভাইরাল সংক্রমনে এন্টিবায়োটিক এর ব্যবহার নয়
২. চিকিৎসক যেভাবে যতদিন খেতে বলবেন, ঠিক সেভাবে ততদিন খেতে হবে। ভালো বোধ করলেই খাওয়া বাদ দেয়া যাবে না।
৩. অন্য কারো বেঁচে যাওয়া এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন এন্টিবায়োটিক প্রয়োজন।
সূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Antimicrobial_resistance
https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/antibiotic-resistance