মহামতি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার শতবর্ষ আগে বলে গেছেন, “দুনিয়াটা এক রঙ্গমঞ্চ, আর নারী পুরুষ সবাই অভিনেতা”। অতি উত্তম! কিন্তু উনি যদি ভেবে থাকেন, বয়সকালে পৌঁছে আমরা নাটক করি, তাহলে ভুল! আমরা নাটক করি জন্মের সাতদিন পর থেকেই। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, ডিম্বাণুর সাথে শুক্রাণুর মিলন হওয়ারও আগে থেকে মায়ের দেহ হয়ে উঠে রঙ্গমঞ্চ, আর বাবার দেহ হতে ঝাঁকে ঝাঁকে শুক্রাণু এসে ঐ মঞ্চে শুরু করে নাটক।
কীভাবে?
মায়ের ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রতি মাসে নিষিক্ত হওয়ার জন্য একটা করে মাত্র ডিম্বাণু আসে। আর যৌনমিলনের পর বাবার দেহ হতে যে লক্ষ কোটি শুক্রাণু মায়ের দেহে ঢুকে, তারা ঐ একটা নায়িকার পেছনেই ছুটে। নায়িকার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য নায়কদের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। কারণ, যে পারবে ডিম্বাণুর আবরণ ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে, সেই-ই হবে সন্তানের বাবা। এক্ষেত্রেও সার্ভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট! সবচেয়ে শক্তিশালী শুক্রাণুগুলোই সার্ভিক্স, জরায়ু ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ফেলোপিয়ান টিউবে ঢুকতে পারে। আবার সেখানে ঢুকে শুরু হয় আরেক নাটক। অনেক শুক্রাণুই ডিম্বাণুর আবরণে ধাক্কা দিতে থাকে ভেতরে ঢুকার জন্য। কিন্তু ডিম্বাণু শুধুমাত্র একটা শুক্রাণুকেই নির্বাচিত করে নিষেক প্রক্রিয়ার জন্য। ভাবছেন গুল মারছি? নাহ, শুধু মুখের কথায় হলে গুলপট্টির সুযোগ থাকে। কিন্তু ছবি যেখানে কথা বলে, কবি সেখানে নীরব!
সত্তরের দশকে সুইডেনের চিত্রসাংবাদিক লেনার্ট নিলসন কিছু জগদ্বিখ্যাত ছবি তুলেছিলেন, যেগুলো দিয়ে তৈরি হয়েছিলো “A Child is Born” নামক বই। এটা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ইলাস্ট্রেটেড বইয়ের তকমা নিয়ে ঘুরছে। বইটির বিষয়বস্তু হয়তো আঁচ করতে পেরেছেন – মায়ের দেহে শুক্রাণু ঢুকার পর থেকে একটা শিশু জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত মাতৃগর্ভে কী কী নাটক ঘটে, সেটা।
কী নেই এই বইয়ে? ডিম্বাণুর নিষিক্ত হওয়া, কোষ বিভাজন, জরায়ুর দেওয়ালে ভ্রূণ স্থাপিত হওয়া, ভ্রূণের বেড়ে উঠা – সবই! এগুলো দেখে অবশ্য আমি ধাক্কা খেয়েছি প্রথমে। কিছু কিছু জায়গায় শরীর শিরশির করে উঠেছে। মনে হয়েছে, বিচ্ছিরি এবং ভয়ংকর। কিন্তু তারপরও নতুন প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারটা এতো বিস্ময়কর যে, সেটার ধাপ দেখতে পারাটাও বিরাট ব্যাপার!
বইটিতে নিলসনের ছবিগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন ডাঃ Axel Ingelman-Sundberg, এবং ডাঃ Claes Wirsén। তারা গর্ভাবস্থার বিভিন্ন ধাপ এবং গর্ভবতী মায়ের যত্ন নিয়েও পরামর্শ দিয়েছেন। এই বইয়ের কিছু ছবি পাঠানো হয়েছিলো মহাকাশযান ভয়েজার ১ আর ভয়েজার ২-তেও।
১৯৬৫ সালের ৩০ এপ্রিল, বিখ্যাত “টাইম” ম্যাগাজিন “Drama of Life Before Birth” শিরোনামে বিরাট একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছিলো নিলসনের এই কাজের উপর। আসলে কাজটা শুরু করার আগে নিলসন যখন টাইমকে বলেছিলেন, তিনি ভ্রূণের বিভিন্ন ধাপের রঙিন ছবি তোলার পরিকল্পনা করছেন, তখন টাইম সেটাকে “মিশন ইম্পসিবল” বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু গম্ভীর মুখে নিলসন বলেছিলেন, “যখন আমি কাজটা শেষ করবো, তোমাদের কাছে নিয়ে আসবো।” আর দেখো দিকিনি কাণ্ড! ঠিকই ইথান হান্টের মতো দশ বছর পর নিলসন তার মিশন সমাপ্ত করে নিন্দুকের মুখে ঝামা ঘষে দিলেন।
তাহলে আর দেরি না করে চলুন, ধাপে ধাপে দেখে নিই ছবিগুলো। সংগ্রহ করা হয়েছে লেনার্ট নিলসন ফটোগ্রাফি থেকে। প্রায় ১২ বছর ধরে ভ্রূণের ছবি তুলে নিজের হাত যে ভালোই পাকিয়েছেন নিলসন, সেটা বুঝা যায় ছবিগুলো দেখলে।
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
…
আমার মতো আপনিও নিশ্চয় ভাবছেন, হাও দা হেল ডিড হি ডু দ্যাট?
বেশ, এখানেই আসছে কিছু কিরিঞ্চির কথা। নিলসন ছবিগুলো তোলার জন্য ব্যবহার করেছিলেন ম্যাক্রো লেন্সযুক্ত সাধারণ ক্যামেরা, এন্ডোস্কোপ যন্ত্র, এবং স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। যেসব ছবি আমরা দেখলাম, এগুলো সবই যে মায়ের দেহের ভিতরে তোলা, তা নয়। বেশিরভাগ ছবিই Aborted (অ্যাবরশন করা) ভ্রূণের। আর এসকল ভ্রূণ নিয়ে কাজ করার সময় নিলসন রঙ, আলো, কিংবা ভ্রূণের অঙ্গভঙ্গি (যেমন, ভ্রূণের মুখে ভ্রূণের আঙুল রাখা) নিয়ে বিস্তারিত কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে যত রঙচঙে ভাবে আপনি এগুলো দেখছেন, বাস্তবের ঘটনাগুলো এতো রঙচঙে নয়। ছবি তোলার পর বাড়তি রঙ চড়ানো হয়েছে।
আপনারা এখানে গিয়ে অ্যা চাইল্ড ইজ বর্ন বইয়ের আরো কিছু ছবি দেখতে পারবেন।