বলুন তো কীভাবে আমরা পৃথিবীর কেন্দ্র সম্পর্কে জানব? সেখানে রয়েছে অত্যুচ্চ তাপমাত্রা, অত্যন্ত বেশী চাপ এবং প্রচলিত যন্ত্রপাতির পক্ষেও ঐ দূরত্বে যাওয়া সম্ভব না।
উত্তরঃ এজন্য বিজ্ঞানীরা seismic wave বা ভূকম্পন তরঙ্গের উপর নির্ভর করেন। এই তরঙ্গগুলো ভূমিকম্প, বিস্ফোরণ ইত্যাদির ফলে উৎপন্ন হয় এবং পৃথিবীর অভ্যন্তর ও উপরিভাগ দিয়ে চলাচল করে। এগুলো থেকেই পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এসব তথ্যের মাধ্যমেই ঊনিশশো শতাব্দীর শেষদিকে জিওফিজিসিস্টরা বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে তরল পদার্থ, যাকে ঘিরে আছে কঠিন আবরণ। এই আবরণকে আবার ঘিরে আছে কঠিন পৃষ্ঠদেশ যাকে আমরা ভূত্বক বলি। কিন্তু এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন ডেনিশ সিস্মোলজিস্ট ইঙ্গ লেম্যান।
১৯২৯ সালে নিউ জিল্যান্ডের কাছে বিশাল এক ভূমিকম্প হয়। ইঙ্গ এই ভূমিকম্পের শক ওয়েভগুলো পর্যবেক্ষণ করে অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন কিছু P-wave, পৃথিবীর কেন্দ্র দ্বারা যেগুলোর বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো ভূকম্পন স্টেশনে ধরা পড়েছে। এ থেকে তিনি ধারণা করেন, ওয়েভগুলো কেন্দ্রের কিছুটা ভেতরে ঢুকার পর কোনো এক সীমানার সাথে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে এসেছে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তিনি ১৯৩৬ সালে একটি গবেষণাপত্রে লিখেন – পৃথিবীর কেন্দ্র দুটো অংশ দ্বারা গঠিত।
১) একদম কেন্দ্রে একটি কঠিন অংশ এবং
২) কঠিন অংশটিকে বেষ্টন করে থাকা একটি তরল অংশ।
ইঙ্গের হাইপোথিসিস নিশ্চিতভাবে গৃহীত হয় ১৯৭০ সালে।
১৯৯৩ সালে ১০৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা এই নারী বিজ্ঞানী জীবদ্দশায় খুব দুঃখ করেছিলেন মেয়েদের প্রতি বিজ্ঞান মহলের আচরণ দেখে। ১৯৮০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ছেলে এবং মেয়ের বুদ্ধিমত্তায় কোনো পার্থক্য পাওয়া যায় নি। কিন্তু হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলাম, সবাই এভাবে ভাবে না।” আরেকবার নিজের ভাগ্নে/ভাস্তে নীল গ্রোসকে বলেছিলেন, “তোমার জানা উচিৎ কতো অযোগ্য পুরুষের সাথে আমাকে প্রতিযোগিতা করতে হয় – অকারণে।”
****** ****** ******* ইঙ্গ লেম্যান সম্পর্কে কিছু তথ্য ****** ****** ******
• ইঙ্গ লেম্যান তাঁর পড়াশোনা শুরু করেন বিজ্ঞানী নিলস বোরের আন্টি হান্না এডলার পরিচালিত বিদ্যালয়ে, যেখানে ছেলেমেয়ে উভয়কেই সমান চোখে দেখা হতো। এটা ছিল ঐ সময়ের জন্য খুবই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা!
• ইঙ্গের বাবা আলফ্রেড লেম্যান ছিলেন এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিস্ট। ইঙ্গের মতে, তাঁর বাবা এবং হান্না এডলার ছিলেন ইঙ্গের বুদ্ধিমত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।
• ১৯১০ সালে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়তে যান। কিন্তু ১৯১১ সালে দেশে ফিরে আসেন পড়াশোনার ব্যাপারে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে। প্রায় সাত বছর পড়াশোনা থেকে দূরে থাকার পর ১৯১৮ সালে তিনি কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় পড়তে আরম্ভ করেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি ফিজিক্যাল সায়েন্স এবং গণিতের উপর দুটো ডিগ্রী নিয়ে নেন।
• ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কয়েক বছর চাকরী করার পর জিওডেসিস্ট নিলস নরল্যান্ডের সহকারী হিসেবে যোগ দেন ইঙ্গ। জিওডেসি হল পৃথিবীর আকার-আকৃতি পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের বিজ্ঞান। নিলস তাঁকে ডেনমার্ক এবং গ্রিনল্যান্ডে ভূকম্পন স্টেশন স্থাপনের কাজ দেন। এখান থেকেই সিস্মোলজির প্রতি ইঙ্গের আগ্রহ তৈরি হয়।