জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে স্টিফেন হকিং এর অবদান কী সেটা আমরা সকলেই কম বেশি জানি। তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল কৃষ্ণ গহ্বর। সেই আবিষ্কার তাঁকে খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে দিয়েছিল। কৃষ্ণ গহ্বরের বিকিরণ সম্পর্কে তিনি যে তত্ত্ব দিয়েছেন তাতে কোন ভুল ছিল না। তবে একটা জায়গায় এসে বেশ কিছু বিজ্ঞানী হকিং এর ধারণায় মারাত্মক একটি অসঙ্গতি খুঁজে পেলেন। তাঁরা বললেন, হকিং বিকিরণে কোনরূপ সুশৃঙ্খলতা বজায় থাকে না। অর্থাৎ এই বিকিরণ হয় এলোমেলোভাবে। কোয়ান্টাম তত্ত্বমতে, কণার এলোমেলো বিকিরণের কারণে কৃষ্ণ গহ্বর থেকে কোন তথ্যই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
এর অর্থ- কৃষ্ণ গহ্বরে যা কিছুর পতন হয় সেগুলোর কোন তথ্যই আর পাওয়া যায় না; সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এই ঘটনাটি ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য এক বড় ধাক্কা। হকিং তথ্য হারিয়ে যাওয়ার এই বিষয়টিকে “Black Hole Information Paradox” নামে অভিহিত করেন। আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তি ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’। এর সূত্র ধরে হকিং আর একটি বিখ্যাত উক্তির জন্ম দিলেন- “ঈশ্বর শুধু পাশা খেলেন তাই নয় বরং মাঝে মাঝে পাশার ঘুটি এমন জায়গায় নিক্ষেপ করেন যে তা আর পাওয়া যায় না”।
কিপ স্টিফেন থর্ন এবং স্টিফেন হকিং প্রস্তাব করেন, প্রয়োজনে কোয়ান্টাম তত্ত্বে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে যার মাধ্যমে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে বোঝা যাবে। ক্যালটেক-এর বিজ্ঞানী জন প্রেসকিল, থর্ন ও হকিং এর মতের বিরোধিতা করেন। প্রেসকিল মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্যগুলো কোন অবস্থাতেই হারিয়ে যেতে পারে না। এরই ফলশ্রুতিতে হকিং ও প্রেসকিল এর মধ্যে বাজি ধরাধরির সৃষ্টি হয়। এটা ১৯৯৭ সালের ঘটনা। বাজিতে হকিং এবং থর্ন কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্য শূন্য হয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী, আর প্রেসকিল তথ্য টিকে থাকার পক্ষপাতী। বাজির শর্ত অনুযায়ী যে পক্ষের জয় হবে সেই পক্ষকে হেরে যাওয়া পক্ষ থেকে চাহিদা মাফিক এনসাইক্লোপেডিয়া প্রদান করতে হবে।
সমগ্র পৃথিবীর প্রথম সারির সব বিজ্ঞানী অধীর আগ্রহে বাজির এই জয় পরাজয় দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ মালদাসিনা গণিতের মাধ্যমে (হলোগ্রাম ভিত্তিক গণিত যেখানে ত্রিমাত্রিক স্থানের ঘটনাকে দ্বিমাত্রিক স্থানের আওতায় এনে একটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়) দেখাতে সক্ষম হন যে, কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্যগুলো অবশ্যই এর ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে। এর কয়েক বছর পর কাভলি ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স, সান্তা বারবারার পদার্থবিদ ম্যারলফ দেখালেন, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সবগুলো প্রতিরূপ মালদাসিনার গবেষণা ফলকে সমর্থন করে। ২০০৪ সালে হকিং পরাজয় স্বীকার করেন এবং বাজির শর্ত অনুসারে প্রেসকিলকে বেসবল এনসাক্লোপেডিয়া প্রদান করেন।
একটি সমস্যার সমাধান নতুন এক সমস্যার উদ্ভব ঘটায়- এ যেন জগতের এক চিরাচরিত নিয়ম। প্রশ্ন উঠলো- কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্য যদি হারিয়ে না যায় তবে এই তথ্য কীভাবে বাইরের দুনিয়ার সাথে সম্পর্কিত হয়? নব্বই-এর দশকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, কৃষ্ণ গহ্বর ও কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ লেনার্ড সাসকিন্ড হকিং বিকিরণের কোয়ান্টাম অবস্থার জন্য ‘এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’ এর ধারণা প্রদান করেন। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব- এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই কাভলি ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স, সান্তা বারবারার তন্তু তত্ত্ববিদ পোলচিনস্কি তাঁর দু’জন ছাত্র আহমদ আলমেইরি ও জেমস সালি এবং ফেলো ডোনাল্ড ম্যারলফ নতুন ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন। সমস্যাটির নামকরণ করা হয়েছে “অগ্নিপ্রাচীর স্ববিরোধ” (Firewall Paradox)। খুবই সংক্ষিপ্ত একটি উদাহরণের মাধ্যমে “অগ্নিপ্রাচীর স্ববিরোধ” বোঝানো সম্ভব। আমিও সেই পথেই এগোবো। তবে উদাহরণটিতে কিছুটা রোম্যান্টিকতার ছোঁয়া পেতে পারেন। আমরা এখানে কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত কণা বা হকিং বিকিরণে বিদ্যমান কণার পরিবর্তে মানুষ এলিস এবং ববকে বিবেচনা করবো। এখানে সাসকিন্ড এর ‘এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’ ধারণাটি ব্যবহার করতে হবে কেননা আমরা এখন জানি যে, কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত যে কোন কিছুর তথ্য বজায় থাকে এবং সেটা সম্ভব এনট্যাঙ্গেলমেন্ট-এর মাধ্যমে। এক জোড়া কণার একটি, যেটা কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত হয় সেটা অপর কণা, যেটা বাইরে বেরিয়ে যায় সেটার সাথে একটি সম্পর্কসূত্র দ্বারা আবদ্ধ থাকবে।
আমাদের উদাহরণে এলিস যদি কৃষ্ণ গহ্বরে অবস্থান করে আর বব বাইরে থাকে তবে তাদের মধ্যেকার আত্মিক টান অবশ্যই একজন অপরজনকে দূর থেকেও প্রভাবিত করবে। তবে এলিস ও বব এর সম্পর্কের মাঝে আরও একজনের আবির্ভাব ঘটবে যাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ধরা যাক নতুন চরিত্রটির নাম টেড। টেড-এর অবস্থান ঘটনা দিগন্তের একেবারে গা ঘেঁষে। বব এর মতো টেডও এলিস এর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী। মনে রাখতে হবে, এখানে সম্পর্ক তৈরি করার অর্থ- এনট্যাঙ্গেলড হওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে টেড-এর আগমন কেন? আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, স্থান যদি যথেষ্ট মসৃণ হয় এবং কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব সঠিক হয় তবে টেডকে আমাদের আলোচনায় আনতেই হবে।
আর কাহিনীতে টেড-এর প্রবেশ মানে- এলিসের সাথে তারও একটি রোম্যান্টিক সম্পর্ক তৈরি হবে। তবে কাহিনীতে টেড-র অনুপ্রবেশই মূলত অগ্নিপ্রাচীর সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। কেননা মনোগ্যামি অফ এনট্যাঙ্গেলড (Monogamy of Entangled)-এর নিয়ম অনুসারে একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম (এখানে কৃষ্ণ গহ্বরের সাথে সম্পৃক্ত সকল এনট্যাঙ্গেলমেন্ট প্রক্রিয়া, যাকে একটি মাত্র কোয়ান্টাম সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত ধরা হচ্ছে) সম্পূর্ণ স্বাধীন দুটো সিস্টেমের (এখানে এলিসের সাথে বব এবং টেড উভয়ের এনট্যাঙ্গেলমেন্ট) সঙ্গে একই সাথে পুরোপুরি এনট্যাঙ্গেলড হতে পারে না। যার ফলে যদি এলিস এবং ববকে পরস্পরের সাথে এনট্যাঙ্গেলড হতে হয় (কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্য জীবিত রাখতে হলে এটাই করতে হবে) তবে এলিসকে অবশ্যই টেড-এর সাথে সম্পর্ক ভেঙেই সেটা করতে হবে। বিষয়টা অনেকটা গরুর বেড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো অবস্থা যেখানে গরুটিকে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হবে বেড়া ডিঙানোর জন্য, যে শক্তি কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে একটি অগ্নিপ্রাচীররূপে আবির্ভূত হবে এবং সেটা কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা দিগন্তকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখবে। এই সমস্যার সমাধানকল্পে বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানীরা মিলিত হয়েছিলেন, যার যার মতামত ব্যক্ত করেছেন, হয়েছে তর্ক বিতর্ক। তবে এর ফলে যে অগ্নিপ্রাচীর সমস্যার সমাধান হলো তা কিন্তু নয়। কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা দিগন্তে গিয়ে যেহেতু ঘটনাটি দেখা সম্ভব নয় সেহেতু এর অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। একটি কথা ঠিক যে, মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণার অনেক সিদ্ধান্তই কাগজে কলমে হিসাব নিকাশের উপর নির্ভর করে এবং অগ্নিপ্রাচীর স্ববিরোধ সেরকমই একটা সিদ্ধান্ত। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের অনেকেই হরেক রকম সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। স্টিফেন হকিং সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তবে সম্মেলনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে লেনার্ড সাসকিন্ডের একটি সমাধান সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সমাধানটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ওয়ার্মহোল।
সাসকিন্ড ও মালদাসিনা বললেন, কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরের কণা বাইরের কণার সাথে অথবা আরও সঠিকভাবে বললে হকিং কণাগুলোর সমন্বয়ে সৃষ্ট আরেকটি কৃষ্ণ গহ্বরের সাথে এনটেঙ্গলড হয় ওয়ার্মহোল এর মাধ্যমে। সুতরাং এই অনুকল্পে ওয়ার্মহোল এর অস্তিত্ব কোন প্রকার সন্দেহ ব্যতিরেকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এটাও সর্বজনগ্রাহ্য কোন তত্ত্ব নয়; অনুকল্প মাত্র। সুতরাং বলা চলে অগ্নিপ্রাচীর সমস্যার গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান এখনও মেলেনি। বিজ্ঞানীরাও যে এটা নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছেন তাও নয়। কারণটা আগেই বলেছি- “কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা দিগন্তে গিয়ে যেহেতু ঘটনাটি দেখা সম্ভব নয় সেহেতু এর অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।“