যে কোনো ভালো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি কিছু ভবিষ্যদ্বাণী দেয়। যে তত্ত্বগুলো ভবিষ্যদ্বাণী দেয় সেগুলোকে Law বলা হয়। নিউটনের গতির আইন, কেপলারের গ্রহের গতির আইন, মেন্ডেলের বংশগতিবিদ্যা, আইনস্টাইনের তত্ত্বের আইন- এগুলো সবই ভবিষ্যদ্বাণী বা prediction দেয়। জীববিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিবর্তন তত্ত্ব অন্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মত না। বিবর্তন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী দেয় না, ভবিষ্যদ্বাণী বলতে যা বুঝায়- ভবিষ্যতে কী হবে সে ব্যাপারে বিবর্তন কিছুই বলে না। এর কারণ হচ্ছে বিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে হয়- আর প্রাকৃতিক নির্বাচন অনুমান করা বা আগে থেকে জানিয়ে দেয়া অসম্ভব।
তাই বলে কি তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তন দুর্বল? মোটেও না! বিবর্তনতত্ত্ব কিছু ভবিষ্যদ্বাণী দেয়, যেগুলো অতীতের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে বা অতীতের ব্যাপারে কথা বলে। ডারউইনের এমনই কিছু “অতীত সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী” নিয়ে এই লেখাটি সাজানোর চেষ্টা করছি।
ভবিষ্যদ্বাণী ১ – সরীসৃপ থেকে পাখির বিবর্তনের অনুমান
বিবর্তন তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য হচ্ছে পাখিরা সরীসৃপ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। ডারউইন মনে করতেন যে আধুনিক পাখির ডানার হাড় দেখতে মনে সরীসৃপের হাতের মত, আর এগুলো যেন কোনোভাবে একীভূত হয়েছে। ডারউইন বলেন যে এমন একটা প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যাবে যার হাতের হাড়ে সরীসৃপদের মত আঙ্গুলও থাকবে, পাখির মত পালক থাকবে কিন্তু তার ঠোঁটে বা মুখে সরীসৃপের মত দাঁতও পাওয়া যাবে। সে সময় এটা নিয়ে প্রচুর বিদ্রুপ এবং সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন পালকওয়ালা ডায়নোসর গোত্রীয় প্রাণী Archaeopteryx lithographica এর জীবাশ্ম পাওয়া গেলো তখন দেখা গেলো হাতে আঙ্গুলের হাড় আর পালকের পাশাপাশি এর মুখে সরীসৃপের মত দাঁতও আছে। এবং শুধু একটি lithographica জীবাশ্ম নয়, কয়েকটি জীবাশ্ম দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে আসলেই এদের ধারালো দাঁত ছিল, এবং পালকও ছিল।
ভবিষ্যদ্বাণী ২ – ক্যাম্ব্রিয়ান জীবাশ্ম
ডারউইন ভূতত্ত্ববিদ্যাও পড়েছিলেন। তিনি ভূতাত্ত্বিক সময় আর স্তর সম্পর্কে জানতেন। ডারউইনের সময়ে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের আগের কোনো জীবাশ্ম পাওয়া যায় নি। আর ডারউইন এটাকে তাঁর তত্ত্বের বিরুদ্ধে “valid argument” বলে মেনে নিয়েছিলেন। শেষমেষ ১৯৫৩ সালে প্রাক ক্যাম্ব্রিয়ান জীবাশ্ম পাওয়া গেলো, আর সেগুলো সবসময়ই আশেপাশেই ছিল, কিন্তু এরা ছিল আণুবীক্ষণিক প্রাণী। ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ নিয়ে এই লেখাটি দ্রষ্টব্য।
ভবিষ্যদ্বাণী ৩ – পৃথিবীর বয়স সংক্রান্ত অনুমান
ডারউইনের তত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত সমালোচনা করেন উইলিয়াম থম্পসন যাকে আমরা লর্ড কেলভিন নামেই চিনি; যদিও তার সমালোচনাটুকু তখনকার অসম্পূর্ণ জ্ঞানের হিসেবে বিজ্ঞানসম্মত ছিলো, পরবর্তীতে সেই সমালোচনার ভিত ভেঙে পড়ে। লর্ড কেলভিন তাপগতিবিদ্যার জনক ছিলেন। তাঁর হিসাব অনুযায়ী সৌরজগতের বয়স ২০ মিলিয়ন বছর থেকে ৪০ মিলিয়ন বছরের বেশি না। ডারউইনের তত্ত্ব সঠিক হওয়ার জন্য সময় দরকার ছিল কয়েক হাজার মিলিয়ন বা সোজা কথায় বিলিয়ন বছর। কেলভিনের হিসাব মতে ডারউইনের বিবর্তন মিথ্যা কারণ পৃথিবীর বয়সের চেয়ে কম। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া সম্পর্কে জানার পর আমরা জানতে পারি সূর্যের আসল বয়স ৫০০ কোটি বছরের মত, আর সৌরজগৎ তথা পৃথিবীর বয়স ৪৫০ কোটি বছরের মত। আর এভাবে ডারউইনের জীববিজ্ঞান বিষয়ক তত্ত্ব আমাদের পৃথিবীর বয়স সম্পর্কেও ধারণা দেয় সেই ১৮৫৯ সালেই।
ভবিষ্যদ্বাণী ৪ – প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রজাতির ভবিষ্যদ্বাণী
মাদাগাস্কার দ্বীপে স্টার অর্কিড নামের এক ধরণের ফুল আছে যার পরাগরেণু ফুলের প্রায় এক ফুট ভিতরে থাকে। আর যেহেতু ফুলের গাছটির টিকে থাকার জন্য পরাগায়ণ অবশ্যকরণীয় সেহেতু ডারউইন বলেন মাদাগাস্কার দ্বীপে নিশ্চয়ই এমন একটা প্রাণী আছে যার জিহ্বা এক ফুট লম্বা, আর সে এই ফুলের মধু খেতে গিয়ে এর পরাগায়ণ করে দেয়! ৮০ বছর পরে এই মথটির সন্ধান পাওয়া যায়। Xanthopan morganii praedicta
ভবিষ্যদ্বাণী ৫ – মধ্যবর্তী প্রজাতির ভবিষ্যদ্বাণী
ডারউইন বলেছিলেন- তাঁর তত্ত্ব যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে আমরা মধ্যবর্তী প্রাণীর জীবাশ্ম খুঁজে পাবো। ডারউইন জীবাশ্মবিজ্ঞানেও পারদর্শী ছিলেন, তাই তিনি জানতেন যে দূরবর্তী সম্পর্কিত প্রাণীদের মধ্যেও মৌলিক মিল আছে, আর জীবাশ্ম রেকর্ডে আমরা এই মৌলিক মিল সম্বৃদ্ধ প্রাণীদের খুঁজে পাবো। তখন থেকে লক্ষ লক্ষ ফসিল পাওয়া গেছে, আর এর কয়েকটি lineage প্রায় সম্পূর্ণ।
ভবিষ্যদ্বাণী ৬ – একই পূর্বপুরুষ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী
ক্যারোলাস লিনিয়াসের করা দ্বিপদ নামকরণে বর্ণবাদ জিনিসটা লক্ষণীয় ছিল। তিনি আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন। ডারউইন তখন বলেন যে বর্ণ ব্যাপারটা জীববিজ্ঞানে কোনো মানে রাখে না। আর জীবিত সকল মানুষই একই প্রজাতির যারা এইপের মত পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। ডারউইন Comparative Anatomy’র মাধ্যমে দেখান যে মানুষ আর শিম্পাঞ্জীর মধ্যে পার্থক্য খুবই নগণ্য, আর তাঁর তত্ত্ব মতে এরা একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। জেনেটিক সিকুয়েন্সিং দিয়ে কারো বায়োলজিকাল পিতামাতা নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ তার অনেক দূরবর্তী পূর্বপুরুষও বের করতে পারে। জিনোমিক সিকুয়েন্স এনালাইসিস ডারউইনের এই ভবিষ্যদ্বাণীকে প্রমাণ করে। এই পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে যে বর্ণবাদের কোনো ভিত্তি নেই, আর জীবিত সকল মানুষই একই প্রজাতির, আর আমরা সবাই আফ্রিকার কোনো এক পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছি – যারা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোজন করেছে। Phylogenetics প্রমাণ করে যে মানুষ এইপদের একটা প্রজাতি। কয়েকটি ভিন্ন পরীক্ষা এটাও বলছে যে সকল প্রাণীরই কিছু সার্বজনীন জিন আছে, যা প্রমাণ করে সকল প্রাণীই একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে।
ভবিষ্যদ্বাণী ৭ – বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ অভিযোজনের ভবিষ্যদ্বাণী
উড়তে অক্ষম পাখি, ডারউইন বলেন, উড়তে সক্ষম পাখিদের থেকে বিবর্তিত হয়েছে। বিবর্তন বলছে যে- এরা হয়তো এমন কোনো দ্বীপে (অন্য ভূমি থেকে আলাদা) বিবর্তিত হয়েছে যেখানে তাদের শিকারী প্রাণী কম আছে, আর সে কারণে তাদের আকস্মিক পলায়ন (sudden escape) করতে হয় না। এই নিরাপত্তা তাদের ধীরে ধীরে উড়তে পারার অপ্রয়োজনীয়তার দিকে নিয়ে গিয়েছে। যদি এটা সত্য হয়, তবে বিশ্বের কোনো দুই দ্বীপে একই রকমের উড়তে অক্ষম পাখি সদৃশ প্রাণী পাওয়া যাবে না। বিশ্বের প্রায় সকল দ্বীপই আবিষ্কৃত হয়েছে-আর সেখানকার প্রাণীবৈচিত্র্যও ডারউইনের ভবিষ্যদ্বাণীর সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে।
- অন দি অরিজিন অফ স্পিসিসে ডারউইন লিখেন-
“If it could be proved that any part of the structure of any one species had been formed for the exclusive good of another species, it would annihilate my theory, for such could not have been produced through natural selection.”
Chapter VI, Difficulties Of The Theory
অর্থাৎ যদি এমন কোনো প্রাণী বা প্রজাতির এমন কোনো অঙ্গ পাওয়া যায় যা সেই প্রাণীর কোনো কাজেই লাগছে না, কিন্তু অন্য প্রাণীদের বা প্রজাতির সেবার জন্য কাজে লাগছে- তবে তাঁর তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হবে, কিন্তু এমন কোনো কিছুই প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে থাকবে না।
যেমন ধরুন- ফুলের মধু। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে যে এটা ফুলের কোনো কাজেই আসছে না। কিন্তু, এটি পতঙ্গপালকে আকৃষ্ট করছে- আর তাদের সাথে পরাগরেণুর আদান-প্রদানের মাধ্যমে ফুলের বংশবিস্তার হচ্ছে।
ভবিষ্যদ্বাণী ৮ – একই পূর্বপুরুষ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী
তিমির দুইটি প্রজাতি আছে। দাঁতওয়ালা এবং ছাঁকনি সদৃশ পর্দাযুক্ত- যারা সমুদ্রের জল ছেঁকে আণুবীক্ষণিক প্রাণী খায়। ডারউইনের তত্ত্ব সত্য হলে এমন একটা তিমির জীবাশ্ম পাওয়া যাওয়ার কথা যার দাঁত এবং ছাঁকনির মত পর্দা আছে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে Cell বিজ্ঞানপত্রিকায় একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে Coronodon havensteini এর প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছাঁকনি এবং দাঁত দুইই পাওয়া গেছে।
পরিশেষে
এই লেখার মূল ইচ্ছা বিবর্তনকে প্রমাণ করা না, বিবর্তন ইতোমধ্যেই প্রমাণিত, বৈজ্ঞানিক সমাজে। ফেইসবুকে আর ব্লগের কমেন্ট বক্সে হয়তো না। এই লেখার মূল ইচ্ছা এইটা জানানো যে এই সব ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হতে পারতো, আর সেগুলো ভুল হলে বিবর্তনতত্ত্বও ভুল প্রমাণিত হতে পারতো, কিন্তু তা ঘটেনি। কেন ঘটেনি তা জানতে ক্লিক করুন- এখানে। ধন্যবাদ।