এমন কি কখনও শুনেছেন, একজন ব্যক্তির জীবন বাঁচানোর জন্য জন্ম দেওয়া হয়েছে একটা শিশুকে? মনে হয়, না। এরকম সচরাচর ঘটে না। কিন্তু আজ থেকে বিশ বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘটেছিলো ঠিক এমনই একটা ঘটনা। “আয়ালা” পরিবারের একজন সদস্যকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জন্ম নিয়েছিলো ফুটফুটে এক শিশু। সে পৃথিবীতে এসেছিলো শুধুমাত্র বড় বোনের মৃত্যু ঠেকাতে। হ্যাঁ, এই প্রেক্ষাপটের জন্য তখন সারা বিশ্বেই তৈরি হয়েছিলো তুমুল বিতর্ক। একজনকে বাঁচাতে আরেকজনের পয়দা হওয়াটা যেন কিছুতেই মানুষের নৈতিক মনে হচ্ছিলো না। কিন্তু আয়ালা দম্পতি ছিলেন অটল। আর কোনো রাস্তা না থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলেন যে, সন্তানের জন্ম দেবেন। এই সন্তানের শরীরের কিছু অংশ দিয়ে রক্ষা করবেন বড় সন্তানকে।
কি, চমকে গেলেন? চমকানোর কথাই বটে। লস এঞ্জেলেসের আয়ালা দম্পতি শুধু আপনাকে বা আমাকে নয়, চমকে দিয়েছিলেন সারা বিশ্বকে। নিজেদের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, সাহস, আর সন্তানকে বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টা দিয়ে। আর কেন এই অদ্ভুত মীমাংসায় তাদের আসতে হয়েছিলো, সেই কাহিনিই এখন শোনাবো আপনাদের!
অ্যাবি এবং ম্যারি আয়ালার একমাত্র মেয়ে অ্যানিসা আয়ালা। ১৯৮৮ সালে যখন ওর বয়স ১৬ বছর, তখন ধরা পড়লো দুর্লভ প্রজাতির ব্লাড ক্যান্সার – মায়েলোজেনাস লিউকেমিয়া (myelogenous leukemia)। ডাক্তাররা বলে দিলেন, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা না হলে অ্যানিসাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এখন কথা হল, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা যায় এমন দুজন ব্যক্তির মধ্যে, যাদের টিস্যুর মধ্যে মিল আছে। এই ব্যাপারটিকে বলে টিস্যু কম্প্যাটিবিলিটি। অনাত্মীয়দের মধ্যে এই মিল পাওয়ার হার ২০ হাজারের মধ্যে মাত্র একটি! আর অ্যাবি, ম্যারি কিংবা তাদের বড় ছেলে এইরন – কারও সাথেই অ্যানিসার টিস্যু ম্যাচ করলো না।
আয়ালারা যখন আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও এমন কাউকে খুঁজে পেলেন না যার সাথে অ্যানিসার টিস্যু ম্যাচ করে, তখন সারা দেশে খোঁজ লাগালেন। কিন্তু বিধি বাম, দুই বছরের মাথায়ও কোন ম্যাচ পেলেন না। এদিকে অ্যানিসার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ফলে তাঁরা নিলেন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত!
তাঁরা ঠিক করলেন, আরেকটি সন্তান নেবেন। অনাগত সন্তানের সাথে অ্যানিসার টিস্যুর মিল থাকার সম্ভাবনা মাত্র ২৩%। তবুও তাঁরা এই শেষ চেষ্টাটা করতে চাইলেন। কিন্তু এখানেও সমস্যা। দম্পতির বয়স চল্লিশ পার হয়েছে। অর্থাৎ এই বয়সে ম্যারির সফলভাবে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা মাত্র ৪০% (চল্লিশ পার্সেন্ট)। এদিকে অ্যাবি জন্ম নিয়ন্ত্রনের জন্য করে ফেলেছিলেন ভেসেক্টমি। খালি প্যাঁচ আর প্যাঁচ। কিন্তু দেয়ালে যখন পিঠ থেকে যায়, তখন কোনো প্যাঁচই প্যাঁচ নয়। অ্যাবি অপারেশনের মাধ্যমে ভেসেক্টমি সারিয়ে তুললেন। এরপর স্বামী স্ত্রী সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
১৯৯০ সালের ২ এপ্রিল ম্যারি জন্ম দিলেন কন্যাসন্তান ম্যারিসাকে। ওর বোনম্যারোর সাথে মিল পাওয়া গেলো অ্যানিসার বোনম্যারোর। ফলে ম্যারিসার বয়স যখন মাত্র ১ বছর ২ মাস, তখনই সে প্রথমবারের মতো বোনম্যারো ডোনেট করলো বড় বোনকে। এরপর কেটে গেলো পাঁচটা বছর এবং ১৯৯৬ সালে অ্যানিসা তার ক্যান্সার মুক্তি দিবস পালন করলো। উল্লেখ্য যে, আমেরিকায় টানা পাঁচ বছর ক্যান্সার মুক্ত থাকলে ব্যক্তিকে পুরোপুরি ক্যান্সারমুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়।
টাইম ম্যাগাজিন ১৯৯১ সালে তাদের এক সংখ্যায় এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপালে এর বিপক্ষে অনেক মতবাদ শুরু হয়। অনেকে ম্যারিসাকে চিহ্নিত করেন ‘biological resupply vehicle’ হিসেবে। কিন্তু ম্যারিসা স্বয়ং এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, “তারা আমার পরিবার সম্পর্কে জানে না। তারা হয়তো আমাদের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করে দেখেনি। চিন্তা করে নি প্রশ্নটা, ‘আমি কি আমার বাচ্চার জন্য এমনটা করতাম?’”
আশ্চর্য ব্যাপার হল, ম্যারিসার জন্মের পর প্রায় ১ লাখ লোক অ্যানিসার জন্য বোনম্যারো ডোনেট করার তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। মজা হল, এই নাম লেখানোর ঐতিহ্যটা চলেছিল প্রায় ২০ বছর ধরে! সেই সাথে আয়ালা পরিবার প্রচুর পরিমাণে হেইট মেইল বা ঘৃণার চিঠিও পেয়েছেন। বাট ইউ নো, হেটারস গনা হেইট। কিন্তু এর জন্য থেমে থাকে না মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ।
এখন অ্যানিসার বয়স ৪৩ বছর আর ম্যারিসার বয়স ২৫। দু’বোনই পরস্পরকে নিয়ে সুখী।
একটু মিল কি পাচ্ছেন, My Sister’s Keeper মুভিটির সাথে?
যখন প্রথম পড়লাম এই ঘটনা, সারা শরীর শিরশির করে উঠেছিলো। কেমন একটা অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছিলো আমাকে। ভাবছিলাম, সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মানুষ কতকিছুই না করতে পারে! কথায় বলে না, ফ্যামিলি কামস ফার্স্ট? আসলেই তাই।
যে মেয়েটির ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার কথা, সেই কিনা নতুন আশ্বাসে হেসে উঠে! কিছুদিন পর জানতে পারে, সে বেঁচে গেছে ক্যান্সারের থাবা থেকে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে কি?
তথ্য সূত্রঃ
১) ডেইলি মেইল ইউকে ১, ডেইলি মেইল ইউকে ২
২) সচলায়তন
৩) টু ডে নিউজ