সমুদ্র জুড়ে বিচিত্র সব প্রাণীর বসবাস। এসব প্রাণীদের আছে অদ্ভুত সব ক্ষমতা যার বেশিরভাগ এখনও মানুষের অজানা। রহস্যঘেরা এই সমুদ্র হাজার হাজার বছর যাবত নাবিক, ডুবুরী, আর অনুসন্ধিংসু মানুষের কাছে অজানাকে জানার এক বিশাল ভাণ্ডার। আমরা সাধারণ মানুষেরা ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল আর পত্র-পত্রিকার আর্টিকেল থেকে তার কিছু অংশ ঘরে বসেই জানতে পারছি। তেমনি এক রহস্যের কিছুটা আমরা আজকে জানার চেষ্টা করব।
রাতের আকাশে আমরা ঝলঝল করা তারকারাজি দেখে অভ্যস্ত। সমুদ্রের বুকেও যে জ্বলে উঠতে পারে রাতের আকাশের মত করেই হাজারো তারকা তা আমরা অনেকেই জানি না। শত-সহস্র বছর ধরে সমুদ্রচারী মানুষ এ বিষয়টিকে নিয়ে তৈরি করেছে নানা জল্পনা-কল্পনা আর রহস্যের ধুম্রজাল। আধুনিককালে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে’র নামানুসারে এর নাম দেয়া হয়েছে “মিল্কি সী (Milky Sea)”। চন্দ্রহীন অন্দকারাচ্ছন্ন রাতে সমুদ্রের বুকে জেগে উঠে এই মিল্কি সী। জুল ভার্ন এর “Twenty Thousand Leagues Under the Seas” এবং হেনরি মেলভিলে’র “Moby Dick” বইগুলতেও মিল্কি সী এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে চলে আসে গ্রীক বিজ্ঞানী আনিক্সিনেমেনেস(Anixinemenes) এর নাম। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে তিনি তার কোনো এক বইতে অদ্ভুত এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেন যদিও এর কোনরূপ ব্যাখ্যা তিনি দাঁড় করাতে পারেননি। এরপর হাজার হাজার বছর ধরে এ নিয়ে লোকমুখে তৈরি হয় ভৌতিক সব গল্প। তবে অধুনা বিজ্ঞানের কাছে আর এই রহস্য অধরা নেই। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় ঘটনাটিকে বলা হয়ে থাকে “Bio-luminescence”; বাংলায় বলা যেতে পারে “জৈব-আলোক”।
সামুদ্রিক প্রাণীরা তাদের দেহে বিশেষ এক ধরনের জৈবরাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন করে এই জৈব-আলোক। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে প্রায় নব্বই ভাগ সামুদ্রিক প্রানিরই এই আলো উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। সমুদ্রের যেকোনো গভীরতায়ই জৈব-আলোকের দেখা মিললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ঘটে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে সমুদ্রের উপরিভাগে। তবে দিনের বেলায় জৈব-আলোক দেখতে চাইলে যেতে হবে গভীর সমুদ্রে যেখানে সূর্যের আলো পৌছায় না। মূলত চারটি কাজে সামুদ্রিক প্রাণীরা এই আলো ব্যবহার করে থাকেঃ কৌশলে শত্রু এড়ানো, খাদ্য আকৃষ্টকরন, নিজ প্রজাতির মাঝে যোগাযোগ রক্ষা এবং নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া।
অধিকাংশ জৈব-আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৪০-৪৭৯ ন্যানোমিটারের মাঝে হওয়ায় তা দৃশ্যমান বর্ণালীর মাঝামাঝি অবস্থানে পড়ে, যার ফলশ্রুতিতে জৈব-আলোক নীল দেখায়। পানিতে নীল আলোর সরণ সর্বাধিক বিধায় গভীর পানি থেকেও এই আলো দৃশ্যমান হয়(একই কারণে পানির নিচের জগৎটা নীল দেখায়)। তবে মজার বিষয় হল অধিকাংশ সামুদ্রিক প্রাণীর দৃষ্টি শুধুমাত্র নীল আলোতেই সংবেদী। নীল আলোর চেয়ে বেশি বা কম তরঙ্গদৈঘের আলো শোষণকারী বর্ণকণিকা এদের মাঝে অনুপস্থিত। তবে নিডারিয়া পর্বের কিছু প্রাণী সবুজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে সক্ষম। মেলাকসটিড গোত্রের কিছু প্রাণী লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে ও দেখতে সক্ষম, যদিও এই লাল আলো অবলোহিত ধরণের হওয়ায় তা মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর দৃষ্টিগোচর হয় না। আর এই বিষয়টিই তাদেরকে শিকার ধরতে সাহায্য করে। অবলোহিত রশ্মির দ্বারা এরা এদের শিকারকে দেখতে পেলেও এদের শিকার ঘুণাক্ষরেও ওঁত পেতে থাকা শত্রুটির উপস্থিতি টের পায় না।
বহুকোষী প্রাণীতে জৈব-আলোক উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয় স্নায়ুকোষের মাধ্যমে। কিছু কিছু প্রাণী নিরবচ্ছিন্নভাবে আলো তৈরি করতে পারলেও অধিকাংশরাই তৈরি করে আলোর ঝলকানি যেগুলোর স্থায়িত্ব ০.১ সেকেন্ড বা এরও কম।
এখন পর্যন্ত জৈব-আলোক উৎপাদনের দুই ধরনের মাধ্যম খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিছু প্রাণী তাদের দেহের ফটোফোর(photophore) নামক এক বিশেষ ধরণের কোষ থেকে জৈব-আলোক তৈরি করে (যেমনঃ অ্যাঙ্গলার মাছ)। অন্যদিকে কিছু প্রাণীর দেহে বিশেষ এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া বাস করে করে যারা জৈব-আলোক তৈরি করে থাকে। তবে জৈব-আলোক ফটোফোর কিংবা ব্যাকটেরিয়া যে মাধ্যমেই তৈরি হোক না কেন রাসায়নিকভাবে এর উৎপাদন কৌশল সবক্ষেত্রে একই। রাসায়নিক এই প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় অক্সিজেনের উপস্থিতিতে। আর এর জন্য প্রয়োজনীয় দুটি রাসায়নিক উপাদান হল- লুসিফেরিন (পিগমেন্ট) এবং লুসিফিরেজ (এনজাইম)। লুসিফিরেজ এনজাইমের প্রভাবে লুসিফেরিন পিগমেন্ট অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে তৈরি করে অক্সি-লুসিফেরিন।
লুসিফেরিন + এডিনোসিন ট্রাইফসফেট -> লুসিফেরাইল এডেনিলেট + পাইরুফসফেট
লুসিফেরাইল এডেনিলেট + অক্সিজেন -> অক্সি-লুসিফেরিন + এডিনোসিন মনোফসফেট + আলোকশক্তি
অক্সি-লুসিফেরিন উৎপন্ন হয় অতি উচ্চ বৈদ্যুতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে। এই বিক্রিয়ার প্রায় সকল শক্তি আলোক শক্তি হিসেবে প্রকাশ পায়। অতি সামান্য পরিমাণ শক্তিই তাপ শক্তি হিসেবে নির্গত হয়। আর এই কারনে জৈব-আলোককে অনেক সময় “শীতল-আলোক(cold light)” বলা হয়ে থাকে।