কার্ল সেগান ও কসমসের সাথে ১৩টি ঘণ্টা | ৪র্থ ঘণ্টা

প্রথম ঘণ্টা           দ্বিতীয় ঘণ্টা          তৃতীয় ঘণ্টা

  কসমস (১৯৮০) সকল এপিসোডের বাংলা সাবটাইটেল

স্বর্গ ও নরক

আমরা সময়ের বিবর্তনে গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কারের শৈশব পর্যায়ে আছি। এই পর্যায়ে এসে আমরা নরকের মতো গ্রহ পেয়েছি আবার স্বর্গের মতো গ্রহও পেয়েছি। আমাদের গ্রহটা সেই হিসাবে স্বর্গের ভিতরেই পড়ে। এই স্বর্গের মতো গ্রহে পরিবর্তন ঘটে এতোই আস্তে যে অনেকে হয়তো সারা জীবন পার করেও বড়সড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখে না। কিছু দেশে হয়তো ৫০০ বছরেও তেমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়াতে সেখানের মানুষ খুব বেশি নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে তো বটেই মানব ইতিহাসেও অনেক ধ্বংসের ও বিপর্যয়ের স্পষ্ট চিহ্ন আছে। সেগান আমাকে বললেন, “এমন অসংখ্য প্রমাণ আছে যে ১০০ বছরে যে বিপর্যয় দুর্লভ, ১০ কোটি বছরে সেই বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী”। এর পরেই সেগান আমাকে গত কয়েক শতাব্দীতে ঘটা বিচিত্র কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মধ্য সাইবেরিয়াতে এক সময় তুঙ্গুস নামে এক জনগোষ্ঠী ছিলো। তাদের ভিতরে একটা অদ্ভুত গল্প প্রচলিত ছিলো। তারা বলতো, ১৯০৮ সালের সকালে আগুনের গোলক নাকি আকাশকে দুভাগ করেছিলো ও পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। সেখান থেকে গরম বাতাস প্রবাহিত হয়েছিলো, যা মানুষ ও বন-জঙ্গল ধ্বংস করেছিলো। ১৯২০ সালের শেষের দিকে এল. এ. কুলিক নামের এক বিজ্ঞানী এই রহস্যের সমাধানে নামলেন। কুলিকের অনুমান ছিলো এক বিশাল উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে ছিটকে পড়েছিলো। তিনি ভেবেছিলেন কোনো গ্রহাণু থেকে ছুটে আসা উল্কাপিণ্ডের সাথে একটা বড়সড় গর্তও তিনি দেখতে পাবেন। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল ছিলো। তিনি ভেঙ্গে যাওয়া গাছপালা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন না। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো জলাভূমির নিচে কোনো কিছুর সন্ধান পাবেন। অনেক অনুসন্ধানের পরও তিনি পাথর বা উল্কাপিণ্ডের কোনো চিহ্ন দেখলেন না। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা জুড়ে গাছপালা ধ্বংস হয়েছিলো। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া সাইবেরিয়া, রাশিয়াসহ ইউরোপেও পাওয়া গিয়েছিলো। এই ভয়াবহ ব্যাপারটাকে বলা হয় তুঙ্গুসকা ইভেন্ট

কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন, এটার কারণ হচ্ছে মহাকাশ থেকে আসা প্রতিপদার্থের টুকরো, যা পৃথিবীর সাধারণ পদার্থের সাথে আঘাতে বিস্ফোরিত হয়েছিলো ও গামা রশ্মির আলোকছটা দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু, ব্যাপারটা প্রমাণ করা যায়নি। কারো মতে ছোট্ট ব্ল্যাকহোলের টুকরা ছিলো ওটা! কিন্তু, এটারও প্রমাণ নেই। কেউ কেউ ভেবেছিলো উন্নত বিশ্বের প্রাণীদের বানানো মহাকাশযান যা পৃথিবীতে এসে ধ্বংস হয়েছিলো। কিন্তু, এটারও প্রমাণ নেই। তাহলে কাহিনী কী?

তুঙ্গুসকা ইভেন্টের মূল ব্যাপার ছিলো, একটা বিশাল বিস্ফোরণ যা শক্তিশালী শকও্য়েভ তৈরী করেছিলো অনেক অনেক গাছ পুড়েছিলো কিন্তু মাটিতে কোনো গর্ত ছিলো না। এই ঘটনার একটাই মাত্র যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে, তা হলো- ‘ইনকে’ ধূমকেতুর অংশ পৃথিবীতে আঘাত করেছিলো। ঘণ্টায় ১ লক্ষ কিলোমিটারের বেশি বেগে ছুটে চলা টুকরোটা বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিলো। এখানে সেগান মজা করে একটা কঠিন বাস্তবতা বললেন। তা হলো-

এখন যদি এই ঘটনা ঘটতো তাহলে অনেকে হয়তো ভাবতো এটা পারমাণবিক অস্ত্রের কাজ। হতেই পারে পরবর্তীতে এমন ঘটনা পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা ঘটাবে। সাধারণ দুর্যোগের মতো ধুমকেতু আমাদের গ্রহে আঘাত হানবে আর মানুষ জবাব দেবে নিজেদের ধ্বংস করার মাধ্যমে।

প্রাচীন মানুষদের ভিতরে ধারণা ছিলো যে ধূমকেতু যুবরাজের মৃত্যু বা রাজত্বের পতন। প্রাচীন চিত্রকর্মগুলো লক্ষ্য করলে এটা বেশ ভালোই বোঝা যায়। তবে, পরিবর্তন আসে ১৫৭৭ সালের দিকে। কিছুটা বাস্তবভিত্তিক চিন্তা-চেতনা গড়ে ওঠে ধূমকেতুকে নিয়ে। এরও প্রায় দুশো বছর পর এডমণ্ড হেলি নামে এক ভদ্রলোক আবিষ্কার করেন এই আলোচিত ধূমকেতু দেখা যায় ৭৬ বছর পরপর। এই আবিষ্কারের পর এটাকে নিয়ে কুসংস্কার প্রায় বিদায় নিলেও পুরোপুরি না! কিছু পত্রিকা পরের শতাব্দীতেও এই ধূমকেতুকে মৃত্যদূত আখ্যা দিতো! এর কিছু বছর পর যুগান্তকারী এক আবিষ্কার কিছু কুসংস্কারও তৈরি করেছিলো! কীভাবে?

১৮০০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা ধূমকেতুর লেজে সায়ানোজেন গ্যাস আবিষ্কার করেন। সায়ানোজেন এক ধরনের বিষ। পৃথিবীর গ্যাসের স্তর পাতলা, এটার ভিতর দিয়েই নাকি যাবে সায়ানোজেন গ্যাস! তখন পত্রিকাগুলো কী লিখেছিলো তার কিছু কাটিং আমাকে দেখালেন সেগান। যেমন- লস এঞ্জেলেস এক্সামিনার এর শিরোনাম ছিলো “ধূমকেতুর সায়ানোজেন কি ভিজিয়েছে আপনাদের? পুরো মানবজাতির জন্য রয়েছে ফ্রি গ্যাস স্নানের ব্যবস্থা। ব্যাপক আনন্দের অপেক্ষায় থাকুন!”

আবার, সান ফ্রান্সিস্কো ক্রনিকলের শিরোনাম ছিলো, “ধূমকেতুর আগমনে স্বামীর পরিবর্তন।“ “ধূমকেতুর আগমনে নিউ-ইয়র্কে পার্টি!” একধাপ এগিয়ে ছিলো কিছু ব্যবসায়ী! উনারা ধূমকেতুর ওষুধ বিক্রি করতো। সেগান মজা করে একটা ওষুধ নিয়ে বললেন, “আমিও একটা খাবো!” আবার অনেকে গ্যাস মাস্ক চালু করেছিলো।

কার্ল সেগান এবার মজা ছেড়ে গম্ভীর হলেন ও আমাকে বললেন, গ্রহগুলো ছোট ছোট পাথর ও লোহা দিয়ে তৈরি। তবে খুব দূরের গুলো গ্যাসের পিণ্ড! ধূমকেতুর জন্ম আরো দুরের মেঘ থেকে। গ্রাভিটির কল্যাণে সূর্যের কাছাকাছি আসতে থাকে সেগুলো। আর, ধুমকেতুর প্রায় পুরোটাই বরফ হওয়ার কারণে সূর্যের কাছাকাছি এলে বাষ্পীভূত হতে থাকে। ধূমকেতুর লেজ তৈরি হয় এভাবেই। কিছু কিছু ধূমকেতু লক্ষ বছরে একবার হয়তো একস্থানে নিজেকে দেখায়! কিছু আছে প্রতিনিয়তই কোনো গ্রহের চারিধারে ঘোরে। খুব কমই আছে হেলির ধূমকেতুর মতো। তবে ধূমকেতুরা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। হ্যালির ধূমকেতু কিছু শতাব্দী পর হয়তো বালির কণার মতো কিছু হয়ে যাবে। চমৎকার এ্যানিমেশনের মাধ্যমে এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন সেগান। বললেন, গ্রহ থেকে গ্রহের দূরত্বে ছোট জিনিসের পরিমাণ অনেক বেশি। গ্রহগুলো নিয়মতই কিছু না কিছু আঘাত সয়ে আসছে। তুঙ্গুসকার মতো ব্যাপারটাও নিয়মিত কোনো ঘটনা! চাঁদ, মঙ্গল সহ অনেক গ্রহের দেহে অনেক অনেক আঘাত দেখি। পৃথিবীও এমন আঘাত সয়ে চলেছে। পৃথিবীতে বেশ কিছু গর্ত অতি সাম্প্রতিক। বেশীরভাগই অনেক পুরোনো। অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে, বায়ুর প্রবাহে, পানির কারণে। পৃথিবীর মতো একটা গ্রহ যদি কোনো কারণে বৃহস্পতিতে আঘাত করে তাহলে ক্ষত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও কম! পৃথিবী এতটাই ছোট!

১১৭৮ সালের একটা ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে ইতিহাসে। একটি চার্চের সন্যাসীদের অনেকেই সন্ধার দিকে আকাশে আলোর এক বিশাল ঝটকা দেখতে পান। জারভেস নামে এক ইতিহাসবিদ এই ঘটনা লিখে রেখেছিলেন তার নোটে। চাঁদের গায়ে আগুনের শিখা!! বর্ণনা অনুযায়ী সেই আঘাতের কারণে চাঁদে কম্পন হওয়া উচিৎ ও সেই কম্পন ৮০০ বছরের থামবে না। সেই ঘটনার ৮০০ বছর পর মানুষ প্রথম চাঁদে পা রাখে। সে সময় কম্পনের পরীক্ষা করা হয়েছিলো। এবং এই পরীক্ষায় চাঁদের মৃদু কম্পন প্রমাণিত হয়েছিলো। শুধু তাই না, সেই অঞ্চলে গর্তের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিলো।

বিজ্ঞানে অনেক হাইপোথিসিস আছে। এটা কোনো ব্যাপার না। বিজ্ঞান নিজেই নিজেকে সংশোধন করে। আর এটাই সত্য উদ্ঘাটনের বড় শর্ত। স্বীকৃতি দেওয়ার আগে নতুন ধারণাকে প্রমাণ করতে হয়। এর পরেই সেগান আমাকে নিয়ে গেলেন শুক্রগ্রহের মাটিতে! গ্রহটাকে দেখিয়ে বললেন ওটার দুঃখের গল্প। সামান্য গ্রীন-হাউজ ইফেক্ট পৃথিবী ও শুক্রের চেহারার পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। পরিবেশের পরিবর্তনের কথা বলতে বলতে আমরা শুক্র থেকে পৃথিবীর এক অসাধারণ স্থান, মিশরে ল্যান্ড করলাম।

মিশরে এসেই মানুষের মতো মাথা, সিংহের মতো দেহের স্ফিংক্স দেখলাম। এটার নাক ক্ষয়ে গেছে যুদ্ধ, ধুলিঝড় ও বৃষ্টির কারণে। এমন অনেক কিছুই ক্ষয়ে যায়। লক্ষ বছরে হারিয়ে যায় আঘাতের চিহ্ন! বৃষ্টির ফোটা, পানির প্রবাহ, ধুলির ঝড়, যুদ্ধ, খরা পাল্টে দিতে পারে যে কোনো কিছু বিরাটভাবে। প্রাচীনকালে গাছ পোড়ানো হতো দরকারে। এখন গাছ পোড়ানো হয় উদাসীনভাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে গাছ পোড়ানোর অবদান অনেক। কার্ল সেগান এই পর্যায়ে একটা দাবি ও প্রশ্ন রেখে গেলেন। বললেন, “নতুন প্রজন্মকে ভাবতে হবে কোনটার গুরুত্ব বেশি। বসবাসযোগ্যতা নাকি স্বল্পকালীন মুনাফা? আমাদের গ্রহ রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত, কিন্তু পরিবেশের দিক থেকে একসুত্রে গাথা। যদি এই ইকোসিস্টেমের একটা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে বাকিগুলোও ভেঙ্গে পড়বে। অন্য গ্রহের মতো অবস্থা কি আমাদের এখানেও তৈরী হবে? প্রাকৃতিক দূর্যোগকে ডেকে আনা হয় না, তারা আসে। তাদের সেই হাত আরো শক্তিশালী করার দরকার আছে কি? পৃথিবীর বাইরে এখনো পর্যন্ত থাকার জায়গাটাই বা কই? শেষ পর্যন্ত এখানেও কি বরফযুগের সূচনা হবে? আমরা যদি এইভাবেই সব শেষ করি, পরের প্রজন্মকে মুখ দেখাবো কীভাবে?”

সবশেষে তিনি চারটি জিনিস করার উপদেশ দিলেন।

১। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কার্যকর করা। ২৫ মাইলের জ্বালানিতে ৭০ মাইল চলবে এমন গাড়ি তৈরি করা।

২। সৌরশক্তির কার্যকর ব্যবহার।

৩। ব্যাপক হারে বনায়ন করতে হবে।

৪। জনশক্তির ব্যবহার। অর্থাৎ, মানুষদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে।

Comments

Avatar

MHLikhon

বর্তমানে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার বিজ্ঞানে অধ্যায়নরত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও ভ্রমণ নিয়েই চলে যায় দিন! লেখালেখিও এগুলো নিয়েই।

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x